
####
ভারতের রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম কন্নর ভ্রমণে এসে জানতে পারলেন ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ এখানকার একটি মিলিটারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রেসিডেন্ট সিডিউল ভেঙ্গে ১৫ মিনিট সময় বের করে তার সাথে দেখা করলেন, জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছেন, কোন সমস্যা আছে কি? মানেকশ দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বললেন আমার প্রিয় প্রেসিডেন্টকে এত কাছে পেয়েও একটা স্যালুট করতে পারলাম না, স্যার। এক ফাকে মানেকশ প্রেসিডেন্টকে বলেন দীর্ঘ ২০ বছরেও আমি আমার ফিল্ড মার্শাল হওয়ার পেনশন পাইনি। প্রেসিডেন্ট দিল্লি পৌঁছেই ডিফেন্স সেক্রেটারিকে ডেকে পেনশনের ১ কোটি ২৫ লক্ষ রুপির একটি চেকসহ বিশেষ বিমানে ওয়েলিংটনের উটিতে পাঠিয়ে দিলেন। শ্যাম মানেকশ চেকটি হাতে পেয়ে সাথে সাথে আর্মি রিলিফ ফান্ডে জমা করে দিলেন। সেলুট কার প্রাপ্য-এপিজে নাকি মানেক’শ?
শ্যাম মানেকশ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন । একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম মনে আছে তো? আজ এই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান শ্যাম মানেকশের ১৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ (জন্ম: ৩ এপ্রিল ১৯১৪ – মৃত্যু: ২৭ জুন ২০০৮)
দীর্ঘ নামের কারণে তিনি ‘Sam Manekshaw’, ‘Sam Bahadur’, ‘Sam the Brave’ ইত্যাদি নামে বেশি পরিচিত। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ-ভারতীয় মিলিটারি একাডেমি, দেরাদুনে প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে তিনি যোগ দেন এবং ১২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়নে কমিশন লাভ করেন। তার সক্রিয় সামরিক কেরিয়ার চার দশক ধরে বিস্তৃত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চাকরি দিয়ে শুরু হয়েছিল। প্রায় ৪ দশকের দীর্ঘ সামরিক জীবনে তার অর্জন অনেক। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে সামরিক বাহিনীর বহু নামীদামি জেনারেলের জন্ম হয়েছে, যারা পরে বিভিন্ন সময় উভয় দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মানেকশ’।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর প্রধান ছিলেন এবং ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হওয়া প্রথম ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা। এ যুদ্ধে যৌথ বাহিনী জয়ী হয়, পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমেই পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে এবং আজ আমরা বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক।
ফিল্ড মার্শাল শ্যাম হোরামশিজি প্রেমজি “শ্যাম বাহাদুর” জামসেদজি মানেকশ’ (জন্ম-৩রা এপ্রিল, ১৯১৪-মৃত্যু ২৭শে জুন, ২০০৮) পারস্য বংশোদ্ভূত ভারতীয় সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ও ফিল্ড মার্শাল।
তিনি মূলত পারস্যের জরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন যিনি শরণার্থী হিসেবে ভারতে এসেছিলেন। ভারতের শিল্প জগতের পথিকৃৎ জামসেদজী টাটাও এই সম্প্রদায়ের লোক। নেহেরুকন্যা ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধীও ছিলেন পার্শি সম্প্রদায়ের।
জেনারেল শ্যাম মানেকশ (Field Marshal Sam Hormusji Framji Jamshedji Manekshaw) ছিলেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান (Chief of Army Staff)। তিনি কেবল একজন দক্ষ সামরিক কৌশলবিদই ছিলেন না, বরং একজন দূরদর্শী নেতাও, যাঁর কৌশল, ধৈর্য ও নেতৃত্ব ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
নিচে তাঁর অবদানগুলি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—
🔰 ১. কৌশলগত ধৈর্য ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি
মার্চ ১৯৭১ এ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” চালিয়ে গণহত্যা শুরু করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধ চেয়েছিলেন। কিন্তু তখনই সেনা অভিযান শুরু না করার জন্য মানেকশ তাকে অনুরোধ করেন। তাঁর যুক্তি ছিল: ভারতীয় সেনাবাহিনী তখন সীমান্তে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়।বর্ষাকাল শুরু হতে চলেছে, যা পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক পরিবেশে যুদ্ধ পরিচালনায় অসুবিধা সৃষ্টি করবে। আন্তর্জাতিক সমর্থন গঠন জরুরি।
তিনি বলেন: “I guarantee you victory, but on my terms and at my time.”(“আমি আপনাকে বিজয়ের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তবে আমার শর্তে এবং আমার সময়ে।”) এই ধৈর্য এবং পরিকল্পিত প্রস্তুতিই ছিল যুদ্ধজয়ের প্রথম ধাপ।
🔰 ২. মিত্রবাহিনীর (Joint Command) গঠন
মানেকশ-ই প্রথম একত্রে বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের (মুক্তিবাহিনী) এবং ভারতীয় সেনাদের মধ্যে সমন্বিত কমান্ড গড়ে তোলেন: তিনি মেজর জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা-কে পূর্বাঞ্চলের সেনা কমান্ডার করেন।ভারতীয় সেনা, বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা, বিমান ও নৌবাহিনী — সবাইকে নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি হয়।
🔰 ৩. প্রশিক্ষণ ও সহায়তা
ভারতের মাটিতে ১০টি সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি তৈরি করে দেওয়া হয়, যেখান থেকে: অস্ত্র, রসদ, প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।ভারতীয় সেনারা সরাসরি মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেন।
🔰 ৪. ১৩ দিনের যুদ্ধ: ইতিহাসের দ্রুততম বিজয়, ডিসেম্বর ১৯৭১-এ মানেকশর কৌশলে ভারতীয় সেনা পূর্ব-পাকিস্তানে চার দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে: এই যুদ্ধ মাত্র ১৩ দিনেই (৩ ডিসেম্বর – ১৬ ডিসেম্বর) শেষ হয়। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম দ্রুততম সামরিক বিজয়।১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেন।প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ সামরিক আত্মসমর্পণ।মানেকশ ছিলেন এর পেছনের প্রধান স্থপতি।
🔰 ৫. আত্মসমর্পণের সজ্জা ও মানবিকতা
যুদ্ধে বিজয়ের পরও মানেকশ ও ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবিক আচরণ করেন। তিনি বারবার বলেন: > “They have fought for their country, we must treat them with dignity.”
🔰 ৬. ফিল্ড মার্শাল উপাধি , এই অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ: ১৯৭৩ সালে মানেকশকে ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়।
🔰 সারাংশে জেনারেল মানেকশ কেবল এক সামরিক সেনানায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন:দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক,মানবিক বীর,ও মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য বন্ধু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তার নেতৃত্ব ছাড়া কল্পনা করা যায় না। তিনি ছিলেন ভারত-বাংলাদেশের এক অভিন্ন বীর ইতিহাসের মহান স্থপতি।
……………………………………………………..
🇧🇩 জেনারেল শ্যাম মানেকশের বাংলাদেশ সফর: এক বিজয়ীর প্রত্যাবর্তন 🇮🇳 (ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের রক্তলাল সূর্যোদয়ের পর কেটে গেছে কিছুটা সময়। একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র—বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে গেছে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে মাথা উঁচু করে। সে সময় এই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের পেছনে যিনি অন্যতম স্থপতি ছিলেন, সেই ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো বিজয়োত্তর বাংলাদেশে পা রাখেন।এটা কেবল একটি রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না, ছিল এক বিজয়ীর কৃতজ্ঞ ও মানবিক প্রত্যাবর্তন।
🏵️ স্বাগত ও সংবর্ধনা : ঢাকার আকাশে রঙিন পতাকা, শহরের রাস্তাজুড়ে মানুষের ঢল। বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। পরদিন তিনি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান-এর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। মুজিব তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বাগত জানিয়ে বলেন:> “আপনি শুধু ভারতের নয়, বাংলাদেশেরও বীর।”
🛡️ সামরিক সহায়তা ও ঐক্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছিল অভূতপূর্ব। সেই ধারাবাহিকতায় মানেকশের সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল:বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনে সহযোগিতা,মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন বাহিনী গড়ে তোলা,পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাপ,এবং নতুন রাষ্ট্রের সামরিক নীতিমালায় ভারতীয় সহায়তার ক্ষেত্র নির্ধারণ।
🤝 এক অভিন্ন আত্মার মিলন : যুদ্ধ জয়ের আত্মতৃপ্তির বাইরে মানেকশের সফর ছিল দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সম্মান ও ঐতিহাসিক কৃতজ্ঞতার বন্ধন দৃঢ় করার মুহূর্ত। তিনি এদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে বলেন: “বাংলাদেশের জনগণ অসাধারণ সাহস দেখিয়েছে। ভারত কেবল তাদের পাশে ছিল, তারা নিজেরাই নিজেদের মুক্ত করেছে।”
📜 ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় নাম :জেনারেল শ্যাম মানেকশের এই সফর স্মরণ করিয়ে দেয়—তিনি বিজয় চাননি হঠাৎভাবে, চেয়েছিলেন সুনির্বাচিতভাবে।তিনি যুদ্ধকে রক্তপিপাসা নয়, মানবিক প্রয়োজন বলেই দেখেছিলেন।তিনি ছিলেন একজন জেনারেল, যার কাছে অস্ত্রের চেয়ে বড় ছিল মানবিক মূল্যবোধ।
🔖 উপসংহার : ১৯৭২ সালের এই সফর ছিল এক আত্মিক মিলনের উৎসব। যুদ্ধের কাঁটা ঘেরা পথ পেরিয়ে এক জেনারেল এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিজয়ী, স্নেহভাজন, এবং সবচেয়ে বড় কথা—এক বন্ধু হিসেবে।
বাংলাদেশ তাঁকে আজও স্মরণ করে গর্ব ও কৃতজ্ঞতায়।
> জয় বাংলা! জয় হিন্দ!