####
কুষ্টিয়ার ভারত সীমান্তবর্তী দৌলতপুর উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে অনকটাই বিচ্ছিন্ন দুই ইউনিয়ন রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী। দৌলতপুর থানার অধীনে থাকা এই ইউনিয়ন দুটির অবস্থান পদ্মা নদীর ওপারে। এখানকার ৩৬ টি গ্রামে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের বাস, যাদের চিকিৎসা ও জরুরি কাজে জেলা সদর কিংবা উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য শুষ্ক মৌসুমে পাড়ি দিতে হয় কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ বালুচর। শুষ্ক মৌসুমে, অর্থাৎ বছরে ছয় মাসের বেশি এখানকার গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মূল ভূখণ্ডে যাতায়াত করতে হয় মোটরসাইকেলে। আর বর্ষা মৌসুমে ভরা নদী পাড়ি দিতে হয় ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। এভাবেই চলে চরে বসবাসরত মানুষের জীবন। একসময় এখানকার অধিবাসীদের যাতায়াতের জন্য গরু ও মহিষের গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে দুই চাকার মোটরসাইকেল, যা চরের দুটি ঘাট এলাকা থেকে (ভাগজোত ঘাট ও ইসলামপুর ঘাট) চলাচল করে চরের বিভিন্ন এলাকায়। ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলের পাশাপাশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে অন্তত তিন শতাধিক ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালকের। এতে ভোগান্তি কমেছে চরবাসীর। তারা এখন নদীর পাড় থেকে চর পাড়ি দিচ্ছে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে চড়ে।
স্থানীয়রা বলছেন, আগে কৃষিকাজই ছিল এই এলাকার মানুষের একমাত্র আয়ের পথ। কিন্তু এখন মোটরসাইকেল চালিয়েও সংসার চালান অনেকেই। কথা হয় ফিলিপনগর ইউনিয়নের ইসলামপুর নদীর ঘাটে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাহেরমাদি চরের যুবক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা আয় হয়। তবে তেল ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে ৫০০-৭০০ টাকা থাকে। পাশাপাশি রাতে বাড়িতে একটি দোকান চালাই। সাইফুলসহ অন্য মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোর থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চরে চলে মোটরসাইকেল চলাচল। আবার কারও জরুরি প্রয়োজনে ফোন করলে যাওয়া হয় গভীর রাতেও। স্থানভেদে নির্ধারণ করা হয় ভাড়া। তবে দুজন যাত্রীর জন্য যে ভাড়া, একজনের বেলায়ও তা একই। গত তিন বছর ধরে ধু-ধু চরে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন বাংলাবাজারের রতন বিশ্বাস নামের এক যুবক। তিনি বলেন, এই চরের মানুষ প্রতিদিনের কাজে মোটরসাইকেলে চর পাড়ি দেন। ইসলামপুর ঘাটে প্রতিদিন কয়েক শ মানুষ আসা-যাওয়া করেন। হৃদয় হোসেন নামের এক মোটরসাইকেল আরোহী জানান, কুষ্টিয়ার সদর উপজেলা খাজানগর এলাকায় খালার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছেন। মোটরসাইকেলে চর পাড়ি দিয়ে ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজি চালিত অটোরিকশায় উঠবেন। এ সময় কথা হয় বয়োজ্যেষ্ঠ আরোব হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কোর্টে তার একটি মামলাসংক্রান্ত কাজ ছিল। তাই ভোরবেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে কুষ্টিয়ায় গিয়েছিলেন। কাজ শেষ করে তিনি বিকেলে ইসলামপুর নদীর ঘাটে এসেছেন মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরতে। চরের ভেতরের শুকার ঘাট এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম জানান, প্রসবজনিত ব্যথায় স্ত্রী মৌসুমি খাতুনকে নিয়ে রাতে মোটরসাইকেলে করে উপজেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি অপেক্ষা করে বলেন, কবে যে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হবে! তাহলে আমরা একটু শান্তি পাব। যাত্রীদের অপেক্ষায় ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা কামরুজ্জামান নামের এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের সঙ্গে কথা হলে বলেন, সাত বছর ধরে তিনি নদীর ঘাট থেকে চরের মানুষকে জেলা শহরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন। বিনিময়ে ভাড়া নিচ্ছেন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানালেন, মোটরসাইকেল এসে এখন চরের মানুষ খুব আরামে আছে। যখন ইচ্ছে আসা-যাওয়া করতে পারছে। কী ধরনের যাত্রী বেশি হয় তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, কোর্টের আর হাসপাতালের যাত্রী বেশি হয়। চিলমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান জানান, তার ইউনিয়নে ২০টি গ্রামের ২৫ হাজার মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা দুই চাকার মোটরসাইকেল। রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল জানান, তার ইউনিয়নে ১৯টি গ্রামের ১৬টি পদ্মার চরে। এখানে বসবাস করেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। তাদেরও ভরসা মোটরসাইকেল। এ দুই ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, অসুস্থতা, মামলা-মোকদ্দমাসহ সব কাজেই এই অঞ্চলের মানুষকে পোহাতে হয় যোগাযোগের দুর্ভোগ। মূল ভূখণ্ড জেলা সদর কিংবা উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগে বালুচর পাড়ি দিতে হয় এখন দুই চাকার মোটরসাইকেলে। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে ভরসা নৌকা। তবে তারা বলছেন, কয়েকটি স্থানে ব্রিজ ও পাকা রাস্তা নির্মাণ সম্ভব হলে এই গ্রামগুলোর অধিবাসীদের কষ্ট কমে আসবে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী রাকিব হোসেনকে ফোন দিলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান। দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, চরের মানুষের যাতায়াতব্যবস্থা উন্নত করতে ইতিমধ্যে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাগজোত এলাকায় একটি বড় ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে হবে।