০৯:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনিয়ম ও দূনীতিকে পুরষ্কৃত করছেন খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক

  • সুনীল দাস।।
  • প্রকাশিত সময় : ০১:২৫:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল ২০২৪
  • ৪০ পড়েছেন

* সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী নিয়ে বাড়ছে ক্ষোভ, নষ্ট হচ্ছে ভাবমূর্তি
* জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি
* কোন ব্যবস্থা না নিয়ে অনিয়মে জড়িত মিলগুলোকে পুন:বরাদ্ধ দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়েছে

সুনীল দাস :
খুলনায় সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী ও আটা সরবরাহকারী মিলারদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দূর্নীতির অহরহ অভিযোগ উঠলেও গত দুই বছরেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। এমনকি ওএমএসের আটা সরবরাহকারী মিলগুলোর অনেকগুলো এক থেকে দুই বছর বন্ধ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা না নিয়ে বরাদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। এসব মিলগুলো সচল ও উৎপাদনশীল আছে কিনা সে বিষয়ে পরির্দশকদের নিয়মিত পরিদর্শন করে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গম বরাদ্ধ দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এসব আটা-ময়দা মিল মালিক ও পরিদর্শকরা যোগসাজশে বছরের পর সরকারী গম বরাদ্ধ নিয়ে নয়ছয় করছেন। এতে যেমন সরকারের লাখ লাখ টাকা তছনছ হচ্ছে তেমনি নিন্মমানের আটা সরবরাহ করার কারনে নিন্মআয়ের ও ছিন্মমূল মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সম্প্রতি ওএমএস ডিলাদের অভিযোগ ও স্থানীয় কিছু গনমাধ্যমের অনুসন্ধানে এসব অনিয়ম ও দূর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আছে। পরে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তরের পরিদর্শনে ঘটনার সত্যতা পেয়ে কয়েকটি আটা মিলের বরাদ্ধ স্থগিত করা হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা না নিয়ে কয়েক মাস না যেতেই আবারও অনিয়ম-দূর্নীতির আশ্রয় নেয়া মিলগুলোকে আবারও সরকারী গম বরাদ্ধ দিয়ে পুরষ্কৃত করা হচ্ছে। কিন্তু সচল ও ভালো মিলগুলোকে তাদের যতাযথ প্রাপ্য বরাদ্ধ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। একই সাথে যেসব সহকারী ও খাদ্য পরিদর্শকের প্রতিবেদন ও সুপারিশে এসব অনিয়ম ও দূর্নীতি করা হয় তাদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তর। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ জানিয়েছেন সাধারণ মিল মালিক, স্থানীয় ভুক্তভোগী মানুষ ও নাগরিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। একই সাথে অনিয়ম দূর্নীতির সাথে জড়িত আটা মিল মালিক ও খাদ্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবীও জানিয়েছেন তারা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস সূত্রে জানা গেছে, সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচীতে তালিকাভুক্ত ময়দা মিল মালিকদের বিরুদ্ধে ওএমএস ডিলারদেরকে নি¤œমানের আটা সরবরাহের অভিযোগ ও গনমাধ্যম প্রতিনিধিদের নিবিড় অনুসন্ধানে ব্যাপক অনিয়ম, বেশকিছু মিল বন্ধ ও অচল থাকা এবং দূর্নীতির তথ্য বের হয়ে আসে। এরই প্রেক্ষিতে খুলনার সাবেক আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালাম ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তাজুল ইসলামের নির্দেশে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাদল কুমার বিশ্বাসের নেতৃত্বে খাদ্য পরিদর্শক পল্লব ঘোষ ও শফিকুল ইসলামকে সদস্য করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই সাথে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের নেতৃত্বে বিশেষ টিম ওএমএসের আটা সরবরাহকারী মিলগুলো পরিদর্শন করেন। গত বছরের নভেম্বরের ২য় সপ্তাহে আটা সরবারহকারীর তালিকা থেকে ২৯টি মিলের কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ ও বন্ধ এবং উৎপাদশীল না থাকায় ৪টি মিলের বরাদ্দ স্থগিত করা হয়। একই সাথে স্থগিতকৃত রূপসার মেসার্স নিকলাপুর ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, খালিশপুর পুরাতন যশোর রোডের মের্সাস হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, ফুলবাড়ী গেটের মেসার্স ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিল ও খানজাহান আলী রোডের মেসার্স ডায়মন্ড ফ্লাওয়ার মিলের উপ-বরাদ্দ বন্ধ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়। তবে আবারও মিল সচল করায় মেসার্স হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ও মেসার্স ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিলের বরাদ্দ ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আবারো তাদের বরাদ্ধ দেয়া শুরু করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুৃক একাধিক আটা-ময়দা মিল মালিক অভিযোগ করে জানান, সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচীর আওতায় ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চাল-আটা বিক্রির জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মিল মালিকদেরকে গম বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সেখান থেকে ওএমএস ডিলারদেরকে মিল মালিকরা আটা সরবরাহ করে। কিন্তু গত দেড় থেকে দু’বছর ধরে বন্ধ থাকা কিছু মিল মালিক সরকারের বরাদ্ধ গম নিয়ে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে নি¤œমানের আটা কিনে ডিলারদের সরবরাহ করছে। এমনকি অনেক মিল বন্ধ থাকলেও খাদ্য অধিদপ্তর সেসব বন্ধ মিলগুলিকে শত শত টন গম বরাদ্দ দিয়েছে। এ নিয়ে ওএমএস ডিলার ও উৎপাদনশীল সচল মিলারদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিলগুলো পরিদর্শন করে মিলে অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ ও বন্ধ এবং উৎপাদশীল না থাকায় গত বছরের নভেম্বরে চারটি মিলের উপবরাদ্দ বন্ধ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এত বড় প্রতারণা ও অপরাধ করার পরেও মাত্র ২ মাস পরে খাদ্য বিভাগ মেসার্স হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিস ও ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিলকে আবারো গম বরাদ্দ দিয়ে পুরষ্কৃত করেছে। মিলগুলো বড় ধরনের অপরাধ করেও কোন শাস্তি পাচ্ছে না। সেই সাথে খাদ্য বিভাগের যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব অনিয়মের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য বিভাগ। যা অন্যান্য মিলগুলিকে এ ধরনের অপকর্ম করতে আবারও উৎসাহিত করবে বলে মনে করেন এ সব মিল মালিকরা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তাজুল ইসলাম এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, ব্যস্ততার কারণে বিষয়টি নিয়ে আগে চিন্তা করিনি। আটা মিলগুলির বরাদ্দ দেয়ার জন্য উপকমিটির যে সকল সদস্য দায়িত্ব পালন করেছে অবশ্যই তাদের কর্তব্যের অবহেলা ও গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তাদের কর্তব্যের অবহেলার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। ব্যস্ততার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। তবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর অনিয়ম ও দূর্নীতির সাথে জড়িত মিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে গুলিকে কেন পুনরায় বরাদ্ধ দেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে কোন সদ্যুত্তোর দিতে পারেননি তিনি।
খুলনার সদ্য যোগদানকৃত আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, ‘আমি অল্প কয়েক দিন হয়েছে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে এখানে যোগদান করেছি। আমি বিষয়টি আপনার মাধ্যমে অবগত হলাম। খুলনায় সরকারের ওএমএসের কার্যক্রমে আটা সরবরাহকারী বেসরকারী কতটি মিল আছে আমি সেটাও এখনও জানি না। তবে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস দেন তিনি।’
সচেতন নাগরিক সমাজ (সনাক) খুলনার সভাপতি এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা জানান, যে কোন দূর্নীতি ও অনিয়ম হয় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং তাদের দুর্নীতির কারণে। পত্র পত্রিকায় প্রকাশ এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিলগুলো পরিদর্শন করে যেসব মিল দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিলো এমন ৪টি মিলের বরাদ্দ বন্ধ করে দেন। এখানে বিষয়টি পরিষ্কার যে মিলগুলো বন্ধ থাকার পরও গম বরাদ্দ পেয়েছে এবং গমগুলো বাজারে বিক্রয় করে অন্য কোথাও থেকে আটা কিনে তারা ওএমএস ডিলারদেরকে সরবরাহ করেছে। এটা একটি ফৌজদারী অপরাধ। এর বিরুদ্ধে খাদ্য বিভাগের মামলা করা উচিত ছিল এবং তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু খাদ্য বিভাগ তা করেনি। এখানে বিষয়টি আরও পরিষ্কার যে, অসাধু মিল মালিক ও খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা এখানে জড়িত। এসব কর্মকর্তারা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য অসাধু মিল মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে। আর এক্ষেত্রে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কোন ভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন। একই সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানান তিনি। এছাড়া খাদ্য বিভাগের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব দুর্নীতির সাথে যুক্ত ছিলো তাদেরও বিভাগীয় বিচার হওয়া উচিত ছিল। এগুলো হয় না বলে আবার নতুন করে দুর্নীতি শুরু হয়। সুতরাং খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যেমন জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা রয়েছে তেমনি রাষ্ট্রের কাছেও দায়বদ্ধতা রয়েছে। এসব দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা না গেলে দুর্নীতি সাময়িক বন্ধ হবে আবার দ্বিগুন উৎসাহে দুর্নীতি শুরু হবে। খাদ্য বিভাগ আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বরং তারা অপরাধী ও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তারা নিজেরাও অপরাধ করেছে এবং অপরাধীদেরকে উৎসাহী করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সরকারের খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বন্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক (চ: দা:) মোঃ মাহবুবুর রহমান জানান, ‘আমরা খাদ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্থাণীয়ভাবে গিয়ে সব জায়গায় মনিটরিং করা সম্ভব নয়। কারণ সারাদেশে অনেকগুলো মিল আমাদের দেখতে হয়। অনেক সময় মিল বন্ধ থাকে সেক্ষেত্রে মিলারদের আবেদন করতে হয় যে আমার মিল বন্ধ রয়েছে। আমি ২ মাস বরাদ্দ নিবো না। কিন্তু তারা এটা না করে তারা অন্যায় করে। আর আমাদের লোকজন হয়তোবা খেয়াল করে না অথবা তাদের মধ্যে যোগসাজশ থাকতে পারে। ডিসি ফুড তার লোকজন দিয়ে সমস্ত মিলগুলো পরিদর্শন শেষে একটি প্রত্যয়ন দেয় যেসব মিলগুলো চালু আছে তার ভিত্তিতে আমরা মিলগুলোকে গম বরাদ্দ দিয়ে থাকি। কোন মিল বন্ধ থাকার পরও যদি তাদেরকে গম বরাদ্ধ দেয়ার ঘটনা ঘটে এক্ষেত্রে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের মতামত আপনারা নিতে পারেন। এ বিষয়ে তারা কি বলেন। যারা বন্ধ মিলের জন্য সুপারিশ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন কোন ব্যবস্থা নেয়া হলো না। তারা বিষয়টি সম্পর্কে কোন কিছু না বললে আমরা এ ধরনের অনিয়মের বিষয়টি সম্পর্কে জানতেও পারবো না। আর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক যদি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করে তাহলে আমরা অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ##

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

Dainik Madhumati

জনপ্রিয়

কোস্টগার্ডের অভিযানে অস্ত্রসহ আটক -১ 

অনিয়ম ও দূনীতিকে পুরষ্কৃত করছেন খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক

প্রকাশিত সময় : ০১:২৫:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল ২০২৪

* সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী নিয়ে বাড়ছে ক্ষোভ, নষ্ট হচ্ছে ভাবমূর্তি
* জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি
* কোন ব্যবস্থা না নিয়ে অনিয়মে জড়িত মিলগুলোকে পুন:বরাদ্ধ দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়েছে

সুনীল দাস :
খুলনায় সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী ও আটা সরবরাহকারী মিলারদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দূর্নীতির অহরহ অভিযোগ উঠলেও গত দুই বছরেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। এমনকি ওএমএসের আটা সরবরাহকারী মিলগুলোর অনেকগুলো এক থেকে দুই বছর বন্ধ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা না নিয়ে বরাদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। এসব মিলগুলো সচল ও উৎপাদনশীল আছে কিনা সে বিষয়ে পরির্দশকদের নিয়মিত পরিদর্শন করে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গম বরাদ্ধ দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এসব আটা-ময়দা মিল মালিক ও পরিদর্শকরা যোগসাজশে বছরের পর সরকারী গম বরাদ্ধ নিয়ে নয়ছয় করছেন। এতে যেমন সরকারের লাখ লাখ টাকা তছনছ হচ্ছে তেমনি নিন্মমানের আটা সরবরাহ করার কারনে নিন্মআয়ের ও ছিন্মমূল মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সম্প্রতি ওএমএস ডিলাদের অভিযোগ ও স্থানীয় কিছু গনমাধ্যমের অনুসন্ধানে এসব অনিয়ম ও দূর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আছে। পরে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তরের পরিদর্শনে ঘটনার সত্যতা পেয়ে কয়েকটি আটা মিলের বরাদ্ধ স্থগিত করা হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা না নিয়ে কয়েক মাস না যেতেই আবারও অনিয়ম-দূর্নীতির আশ্রয় নেয়া মিলগুলোকে আবারও সরকারী গম বরাদ্ধ দিয়ে পুরষ্কৃত করা হচ্ছে। কিন্তু সচল ও ভালো মিলগুলোকে তাদের যতাযথ প্রাপ্য বরাদ্ধ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। একই সাথে যেসব সহকারী ও খাদ্য পরিদর্শকের প্রতিবেদন ও সুপারিশে এসব অনিয়ম ও দূর্নীতি করা হয় তাদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তর। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ জানিয়েছেন সাধারণ মিল মালিক, স্থানীয় ভুক্তভোগী মানুষ ও নাগরিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। একই সাথে অনিয়ম দূর্নীতির সাথে জড়িত আটা মিল মালিক ও খাদ্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবীও জানিয়েছেন তারা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস সূত্রে জানা গেছে, সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচীতে তালিকাভুক্ত ময়দা মিল মালিকদের বিরুদ্ধে ওএমএস ডিলারদেরকে নি¤œমানের আটা সরবরাহের অভিযোগ ও গনমাধ্যম প্রতিনিধিদের নিবিড় অনুসন্ধানে ব্যাপক অনিয়ম, বেশকিছু মিল বন্ধ ও অচল থাকা এবং দূর্নীতির তথ্য বের হয়ে আসে। এরই প্রেক্ষিতে খুলনার সাবেক আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালাম ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তাজুল ইসলামের নির্দেশে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাদল কুমার বিশ্বাসের নেতৃত্বে খাদ্য পরিদর্শক পল্লব ঘোষ ও শফিকুল ইসলামকে সদস্য করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই সাথে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের নেতৃত্বে বিশেষ টিম ওএমএসের আটা সরবরাহকারী মিলগুলো পরিদর্শন করেন। গত বছরের নভেম্বরের ২য় সপ্তাহে আটা সরবারহকারীর তালিকা থেকে ২৯টি মিলের কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ ও বন্ধ এবং উৎপাদশীল না থাকায় ৪টি মিলের বরাদ্দ স্থগিত করা হয়। একই সাথে স্থগিতকৃত রূপসার মেসার্স নিকলাপুর ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, খালিশপুর পুরাতন যশোর রোডের মের্সাস হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, ফুলবাড়ী গেটের মেসার্স ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিল ও খানজাহান আলী রোডের মেসার্স ডায়মন্ড ফ্লাওয়ার মিলের উপ-বরাদ্দ বন্ধ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়। তবে আবারও মিল সচল করায় মেসার্স হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ও মেসার্স ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিলের বরাদ্দ ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আবারো তাদের বরাদ্ধ দেয়া শুরু করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুৃক একাধিক আটা-ময়দা মিল মালিক অভিযোগ করে জানান, সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচীর আওতায় ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চাল-আটা বিক্রির জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মিল মালিকদেরকে গম বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সেখান থেকে ওএমএস ডিলারদেরকে মিল মালিকরা আটা সরবরাহ করে। কিন্তু গত দেড় থেকে দু’বছর ধরে বন্ধ থাকা কিছু মিল মালিক সরকারের বরাদ্ধ গম নিয়ে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে নি¤œমানের আটা কিনে ডিলারদের সরবরাহ করছে। এমনকি অনেক মিল বন্ধ থাকলেও খাদ্য অধিদপ্তর সেসব বন্ধ মিলগুলিকে শত শত টন গম বরাদ্দ দিয়েছে। এ নিয়ে ওএমএস ডিলার ও উৎপাদনশীল সচল মিলারদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিলগুলো পরিদর্শন করে মিলে অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ ও বন্ধ এবং উৎপাদশীল না থাকায় গত বছরের নভেম্বরে চারটি মিলের উপবরাদ্দ বন্ধ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এত বড় প্রতারণা ও অপরাধ করার পরেও মাত্র ২ মাস পরে খাদ্য বিভাগ মেসার্স হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিস ও ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিলকে আবারো গম বরাদ্দ দিয়ে পুরষ্কৃত করেছে। মিলগুলো বড় ধরনের অপরাধ করেও কোন শাস্তি পাচ্ছে না। সেই সাথে খাদ্য বিভাগের যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব অনিয়মের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য বিভাগ। যা অন্যান্য মিলগুলিকে এ ধরনের অপকর্ম করতে আবারও উৎসাহিত করবে বলে মনে করেন এ সব মিল মালিকরা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তাজুল ইসলাম এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, ব্যস্ততার কারণে বিষয়টি নিয়ে আগে চিন্তা করিনি। আটা মিলগুলির বরাদ্দ দেয়ার জন্য উপকমিটির যে সকল সদস্য দায়িত্ব পালন করেছে অবশ্যই তাদের কর্তব্যের অবহেলা ও গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তাদের কর্তব্যের অবহেলার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। ব্যস্ততার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। তবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর অনিয়ম ও দূর্নীতির সাথে জড়িত মিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে গুলিকে কেন পুনরায় বরাদ্ধ দেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে কোন সদ্যুত্তোর দিতে পারেননি তিনি।
খুলনার সদ্য যোগদানকৃত আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, ‘আমি অল্প কয়েক দিন হয়েছে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে এখানে যোগদান করেছি। আমি বিষয়টি আপনার মাধ্যমে অবগত হলাম। খুলনায় সরকারের ওএমএসের কার্যক্রমে আটা সরবরাহকারী বেসরকারী কতটি মিল আছে আমি সেটাও এখনও জানি না। তবে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস দেন তিনি।’
সচেতন নাগরিক সমাজ (সনাক) খুলনার সভাপতি এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা জানান, যে কোন দূর্নীতি ও অনিয়ম হয় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং তাদের দুর্নীতির কারণে। পত্র পত্রিকায় প্রকাশ এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিলগুলো পরিদর্শন করে যেসব মিল দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিলো এমন ৪টি মিলের বরাদ্দ বন্ধ করে দেন। এখানে বিষয়টি পরিষ্কার যে মিলগুলো বন্ধ থাকার পরও গম বরাদ্দ পেয়েছে এবং গমগুলো বাজারে বিক্রয় করে অন্য কোথাও থেকে আটা কিনে তারা ওএমএস ডিলারদেরকে সরবরাহ করেছে। এটা একটি ফৌজদারী অপরাধ। এর বিরুদ্ধে খাদ্য বিভাগের মামলা করা উচিত ছিল এবং তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু খাদ্য বিভাগ তা করেনি। এখানে বিষয়টি আরও পরিষ্কার যে, অসাধু মিল মালিক ও খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা এখানে জড়িত। এসব কর্মকর্তারা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য অসাধু মিল মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে। আর এক্ষেত্রে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কোন ভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন। একই সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানান তিনি। এছাড়া খাদ্য বিভাগের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব দুর্নীতির সাথে যুক্ত ছিলো তাদেরও বিভাগীয় বিচার হওয়া উচিত ছিল। এগুলো হয় না বলে আবার নতুন করে দুর্নীতি শুরু হয়। সুতরাং খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যেমন জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা রয়েছে তেমনি রাষ্ট্রের কাছেও দায়বদ্ধতা রয়েছে। এসব দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা না গেলে দুর্নীতি সাময়িক বন্ধ হবে আবার দ্বিগুন উৎসাহে দুর্নীতি শুরু হবে। খাদ্য বিভাগ আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বরং তারা অপরাধী ও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তারা নিজেরাও অপরাধ করেছে এবং অপরাধীদেরকে উৎসাহী করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সরকারের খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বন্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক (চ: দা:) মোঃ মাহবুবুর রহমান জানান, ‘আমরা খাদ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্থাণীয়ভাবে গিয়ে সব জায়গায় মনিটরিং করা সম্ভব নয়। কারণ সারাদেশে অনেকগুলো মিল আমাদের দেখতে হয়। অনেক সময় মিল বন্ধ থাকে সেক্ষেত্রে মিলারদের আবেদন করতে হয় যে আমার মিল বন্ধ রয়েছে। আমি ২ মাস বরাদ্দ নিবো না। কিন্তু তারা এটা না করে তারা অন্যায় করে। আর আমাদের লোকজন হয়তোবা খেয়াল করে না অথবা তাদের মধ্যে যোগসাজশ থাকতে পারে। ডিসি ফুড তার লোকজন দিয়ে সমস্ত মিলগুলো পরিদর্শন শেষে একটি প্রত্যয়ন দেয় যেসব মিলগুলো চালু আছে তার ভিত্তিতে আমরা মিলগুলোকে গম বরাদ্দ দিয়ে থাকি। কোন মিল বন্ধ থাকার পরও যদি তাদেরকে গম বরাদ্ধ দেয়ার ঘটনা ঘটে এক্ষেত্রে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের মতামত আপনারা নিতে পারেন। এ বিষয়ে তারা কি বলেন। যারা বন্ধ মিলের জন্য সুপারিশ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন কোন ব্যবস্থা নেয়া হলো না। তারা বিষয়টি সম্পর্কে কোন কিছু না বললে আমরা এ ধরনের অনিয়মের বিষয়টি সম্পর্কে জানতেও পারবো না। আর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক যদি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করে তাহলে আমরা অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ##