১২:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
।। ফলোআপ।। সংবাদ প্রকাশে টনক নড়েছে কাস্টমস কর্র্তৃপক্ষের :

আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের সাবেক মাঝি বক্করের কাস্টমস অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, চোরাই তেল ও মাদকের গোডাউন উচ্ছেদ

####

সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রার আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের সাবেক ট্রলার মাঝি আবু বক্কর গাজী ওরফে বক্কর মাঝি কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জাহাজে চাঁদাবাজি, তেল চুরি, মাদক পাচার ও সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকারসহ বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য এবং নিজস্ব বাহিনী গড়ে সাধারন মানুষকে অত্যাচার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানীসহ গত একযুগেরও বেশী সময় ধরে অপরাধ কর্মকান্ডের বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর অবশেষে টনক নড়েছে খুলনা কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কর্তৃপক্ষের। বরখাস্তকৃত মাঝি বক্করকে আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন খুলনা কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার। একই সাথে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবনের ২টি কক্ষ দখল করে বক্কর মাঝির নিয়ন্ত্রনাধীন চোরাই জ্বালালানী তেল ও মাদক ব্যবসার গোডাউনটিও উচ্ছেদ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত ২২মার্চ দৈনিক মধুমতি পত্রিকায় ‘আংটিহারা কাস্টমসের সাবেক মাঝি বক্করের অপরাধ সাম্রাজ্য, গড়েছে জমি-ঘরবাড়িসহ সম্পদের পাহাড়’ শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এসব পদক্ষেপ নিয়েছেন খুলনার কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মো. আতিকুর রহমান। সোমবার  খুলনা কাস্টমস কমিশনারের বরাত দিয়ে ডেপুটি কমিশনার মো. বেলাল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এতে আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ঘাটে কর্মরত মাঝি ও এলাকাবাসী কাস্টমস কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সরেজমিন পরিদর্শন ও তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা গ্রামের মৃত আমিন গাজীর ছেলে আবু বক্কর গাজী ২০১২ সালে আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের ট্রলার মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করেন। নানান অনিয়ম ও অপকর্মের অভিযোগে ২০১৯সালে তাকে মাঝির চাকরী থেকে বরখাস্ত করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারপরেও কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, নৌপুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে সেখানে কাস্টমস কর্মকর্তার ড্রেস পরে পরিচয় দিয়ে জাহাজে চাঁদাবাজি, তেল চুরি, মাদক পাচার ও সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকার এবং নিজস্ব বাহিনী গড়ে সাধারন মানুষকে অত্যাচার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানীসহ গত একযুগেরও বেশী সময় ধরে গড়ে তুলেছেন বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য। এ অপরাধ কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত নদীপথের সীমান্তবর্তী আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অঘোষিত স¤্রাট হয়ে উঠেছেন বক্কর মাঝি। তার অপরাধ কর্মকান্ডের কেউ প্রতিবাদ করলে হামলা ও মামলায় ফাঁসিয়ে শায়েস্তা করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা, মাঝি বক্করের ভাই হাবিবুর রহমান গাজী ও দেলোয়ার হোসেন গাজী অভিযোগ করে বলেন, মাঝি বক্কর সিন্ডিকেটের অপরাধের বিষয়ে প্রতিবাদ করায় স্থানীয় ওয়ার্ড সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা ও রুহুল আমীন গাজী নামে দুই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে হরিণের মাংস রেখে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে বক্কর মাঝি। তারা আরও জানান, বক্কর মাঝি কাস্টমসের অফিসিয়াল ড্রেস পরে কখনও নিজেকে কাস্টমসের অফিস সহায়ক আবার কখনও কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। এভাবে কর্মকর্তার ভুয়া পরিচয় দিয়ে বক্কর গত দেড় দশক ধরে প্রতারণা, অনিয়ম ও দূর্নীতি এবং সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অপরাধ করে যাচ্ছেন। বক্কর মাঝি সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে তার ভাই আলমগীর গাজী, তানভীর গাজী, ভাগ্নে আলমগীর হোসেন, অলিউর রহমান বাবু, তৈয়বুর গাজী অন্যতম। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক চোরাচালান, জাহাজের তেল চুরি, চাঁদাবাজি, সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকার করে পাচারসহ এলাকায় সাধারন মানুষকে ফাঁসিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

আংটিহারা ঘাটের মাঝি দীলিপ মন্ডল, আব্দুল লতিফ ও হারুন মাঝি এবং স্থানীয় দোকানদার ফারুক হোসেন জানান, আংটিহারা কাষ্টমস শুল্ক ষ্টেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করে বক্কর অফিসের দাপ্তরিক যাবতীয় কাজও করে থাকে। সেকারণে জাহাজের নাবিক ও মাস্টারসহ আংটিহারা নৌরুটে চলাচলকারী বাংলাদেশ-ভারতের জাহাজের সবকিছুই তার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। সে প্রতি মাসে আংটিহারা নৌরুটে যাতায়াতকারী দেড় থেকে দুই’শো ভারতীয় জাহাজের প্রতিটি থেকে ৪০-৫০ লিটার ডিজেল ও জোরপূর্বক জরিমানা আদায়, কাস্টমস অফিস থেকে ছাড়পত্র নিতে প্রতিটি ভারতীয় জাহাজ থেকে ১০হাজার টাকা করে আদায়, ভারতীয় জাহাজে চাউল, গম, ভুট্টা, ভূষি এবং লোহার গুড়ার জন্য প্রতিটি থেকে অতিরিক্ত ১০হাজার টাকা আদায়, প্রতিটি জাহাজে কোভিড-১৯ পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদানে ১’হাজার টাকা আদায়,  প্রত্যেকটি বাংলাদেশী ও ভারতীয় জাহাজ কাস্টমস অফিসে তদন্তের খরচ নামে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা আদায়, পানি সরবরাহ না করেও বিআইডবিøউটিএ’র পাইলটদের কাছ থেকে টাকা আদায় এবং জাহাজের জ¦ালানী তেল পাচার করে থাকে। এছাড়া স্থানীয় ইমিগ্রেশন, নৌপুলিশ, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীদের মদ, অর্থ ও হরিণের মাংসসহ নানাবিধ সুবিধা দিয়ে ম্যানেজ করে মাঝি বক্কর তার অপরাধ কর্মকান্ড নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবন টেন্ডার ছাড়া ভেঙ্গে নিজেই বাড়ির নির্মাণ করেছে। এভাবে বক্কর মাঝি সিন্ডিকেট ও নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে গত দেড় দশকে কয়েকটি ট্রলার, জমি-বাড়িসহ বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। অবৈধ অর্থের জোরে প্রভাব খাটিয়ে এলাকার মানুয়ের উপর অত্যাচার, অনিয়ম-দূর্নীতি ও অপরাধ কর্মকান্ডের যথাযথ বিচারের দাবীও তাদের।

তবে মাঝি আবু বক্কর বলেন, আমি মাঝি ঘাটের দায়িত্বে ছিলাম কিন্তু এখন নেই৷ স্থাণীয় একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও মনগড়া অভিযোগ করছে। মূলত আমি এখানে থাকলে প্রতিপক্ষরা অপকর্ম করার সুযোগ পায় না। সে কারণে এসব বানোয়াট, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। তিনি জাহাজে করে মাদক এনে এবং সুন্দরবনের হরিণ শিকার করে তা পাচার করাসহ অন্যদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়ার বিষয়ও তিনি অস্বীকার করেন। এছাড়া সে স্থাণীয় জনপ্রতিনিধি, কয়রা থানা ও নৌ পুলিশ, কাস্টমস অফিস, ইমিগ্রেশন অফিস, বন বিভাগের কর্মকর্তা, স্থানীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়মিত মাসিক উৎকোচ দিয়ে তার কর্মকান্ড পরিচালনার দাবি করেন।

খুলনা কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মো. বেলাল হোসেন বলেন, ৪-৫ বছর আগে মাঝির কাজ থেকে আবু বক্করকে বাদ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারসহ বেশ কিছু অনিয়ম দূর্নীতির ও প্রতারণার লিখিত অভিযোগ পেয়ে আঞ্চলিক অফিস সুপার লুৎফর রহমান গাজীকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খুলনার কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মো. আতিকুর রহমান জানান, আংটিহারা কাস্টমস ষ্টেশনের সাবেক মাঝি আবু বক্কর গাজীর অনিয়ম দূর্নীতির বিষয়ে ইতিপূর্বে তদন্তে প্রমাণ পাওয়ায় ৪-৫ বছর আগে মাঝির কাজ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারসহ বেশ কিছু অনিয়ম দূর্নীতির ও প্রতারণার লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ইতিমধ্যেই অফিসের বাউন্ডারীর পকেট গেট বন্ধসহ মাঝি বক্করকে কাস্টমস অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। একই সাথে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবনের ২টি কক্ষ দখল করে বক্কর মাঝির নিয়ন্ত্রনাধীন চোরাই জ¦ালানী তেল ও মাদক ব্যবসার গোডাউনটিও উচ্ছেদ করা হয়েছে।এ বিষয়ে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি জানান।  ##

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

Dainik Madhumati

জনপ্রিয়

সাতক্ষীরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মতবিনিময় সভা দু’গ্রুপের হাতাহাতিতে ভন্ডুল

।। ফলোআপ।। সংবাদ প্রকাশে টনক নড়েছে কাস্টমস কর্র্তৃপক্ষের :

আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের সাবেক মাঝি বক্করের কাস্টমস অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, চোরাই তেল ও মাদকের গোডাউন উচ্ছেদ

প্রকাশিত সময় : ০৪:৫০:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ এপ্রিল ২০২৪

####

সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রার আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের সাবেক ট্রলার মাঝি আবু বক্কর গাজী ওরফে বক্কর মাঝি কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জাহাজে চাঁদাবাজি, তেল চুরি, মাদক পাচার ও সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকারসহ বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য এবং নিজস্ব বাহিনী গড়ে সাধারন মানুষকে অত্যাচার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানীসহ গত একযুগেরও বেশী সময় ধরে অপরাধ কর্মকান্ডের বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর অবশেষে টনক নড়েছে খুলনা কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কর্তৃপক্ষের। বরখাস্তকৃত মাঝি বক্করকে আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন খুলনা কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার। একই সাথে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবনের ২টি কক্ষ দখল করে বক্কর মাঝির নিয়ন্ত্রনাধীন চোরাই জ্বালালানী তেল ও মাদক ব্যবসার গোডাউনটিও উচ্ছেদ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত ২২মার্চ দৈনিক মধুমতি পত্রিকায় ‘আংটিহারা কাস্টমসের সাবেক মাঝি বক্করের অপরাধ সাম্রাজ্য, গড়েছে জমি-ঘরবাড়িসহ সম্পদের পাহাড়’ শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এসব পদক্ষেপ নিয়েছেন খুলনার কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মো. আতিকুর রহমান। সোমবার  খুলনা কাস্টমস কমিশনারের বরাত দিয়ে ডেপুটি কমিশনার মো. বেলাল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এতে আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ঘাটে কর্মরত মাঝি ও এলাকাবাসী কাস্টমস কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সরেজমিন পরিদর্শন ও তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা গ্রামের মৃত আমিন গাজীর ছেলে আবু বক্কর গাজী ২০১২ সালে আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের ট্রলার মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করেন। নানান অনিয়ম ও অপকর্মের অভিযোগে ২০১৯সালে তাকে মাঝির চাকরী থেকে বরখাস্ত করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারপরেও কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, নৌপুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে সেখানে কাস্টমস কর্মকর্তার ড্রেস পরে পরিচয় দিয়ে জাহাজে চাঁদাবাজি, তেল চুরি, মাদক পাচার ও সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকার এবং নিজস্ব বাহিনী গড়ে সাধারন মানুষকে অত্যাচার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানীসহ গত একযুগেরও বেশী সময় ধরে গড়ে তুলেছেন বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য। এ অপরাধ কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত নদীপথের সীমান্তবর্তী আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অঘোষিত স¤্রাট হয়ে উঠেছেন বক্কর মাঝি। তার অপরাধ কর্মকান্ডের কেউ প্রতিবাদ করলে হামলা ও মামলায় ফাঁসিয়ে শায়েস্তা করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা, মাঝি বক্করের ভাই হাবিবুর রহমান গাজী ও দেলোয়ার হোসেন গাজী অভিযোগ করে বলেন, মাঝি বক্কর সিন্ডিকেটের অপরাধের বিষয়ে প্রতিবাদ করায় স্থানীয় ওয়ার্ড সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা ও রুহুল আমীন গাজী নামে দুই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে হরিণের মাংস রেখে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে বক্কর মাঝি। তারা আরও জানান, বক্কর মাঝি কাস্টমসের অফিসিয়াল ড্রেস পরে কখনও নিজেকে কাস্টমসের অফিস সহায়ক আবার কখনও কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। এভাবে কর্মকর্তার ভুয়া পরিচয় দিয়ে বক্কর গত দেড় দশক ধরে প্রতারণা, অনিয়ম ও দূর্নীতি এবং সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অপরাধ করে যাচ্ছেন। বক্কর মাঝি সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে তার ভাই আলমগীর গাজী, তানভীর গাজী, ভাগ্নে আলমগীর হোসেন, অলিউর রহমান বাবু, তৈয়বুর গাজী অন্যতম। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক চোরাচালান, জাহাজের তেল চুরি, চাঁদাবাজি, সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকার করে পাচারসহ এলাকায় সাধারন মানুষকে ফাঁসিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

আংটিহারা ঘাটের মাঝি দীলিপ মন্ডল, আব্দুল লতিফ ও হারুন মাঝি এবং স্থানীয় দোকানদার ফারুক হোসেন জানান, আংটিহারা কাষ্টমস শুল্ক ষ্টেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করে বক্কর অফিসের দাপ্তরিক যাবতীয় কাজও করে থাকে। সেকারণে জাহাজের নাবিক ও মাস্টারসহ আংটিহারা নৌরুটে চলাচলকারী বাংলাদেশ-ভারতের জাহাজের সবকিছুই তার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। সে প্রতি মাসে আংটিহারা নৌরুটে যাতায়াতকারী দেড় থেকে দুই’শো ভারতীয় জাহাজের প্রতিটি থেকে ৪০-৫০ লিটার ডিজেল ও জোরপূর্বক জরিমানা আদায়, কাস্টমস অফিস থেকে ছাড়পত্র নিতে প্রতিটি ভারতীয় জাহাজ থেকে ১০হাজার টাকা করে আদায়, ভারতীয় জাহাজে চাউল, গম, ভুট্টা, ভূষি এবং লোহার গুড়ার জন্য প্রতিটি থেকে অতিরিক্ত ১০হাজার টাকা আদায়, প্রতিটি জাহাজে কোভিড-১৯ পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদানে ১’হাজার টাকা আদায়,  প্রত্যেকটি বাংলাদেশী ও ভারতীয় জাহাজ কাস্টমস অফিসে তদন্তের খরচ নামে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা আদায়, পানি সরবরাহ না করেও বিআইডবিøউটিএ’র পাইলটদের কাছ থেকে টাকা আদায় এবং জাহাজের জ¦ালানী তেল পাচার করে থাকে। এছাড়া স্থানীয় ইমিগ্রেশন, নৌপুলিশ, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীদের মদ, অর্থ ও হরিণের মাংসসহ নানাবিধ সুবিধা দিয়ে ম্যানেজ করে মাঝি বক্কর তার অপরাধ কর্মকান্ড নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবন টেন্ডার ছাড়া ভেঙ্গে নিজেই বাড়ির নির্মাণ করেছে। এভাবে বক্কর মাঝি সিন্ডিকেট ও নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে গত দেড় দশকে কয়েকটি ট্রলার, জমি-বাড়িসহ বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। অবৈধ অর্থের জোরে প্রভাব খাটিয়ে এলাকার মানুয়ের উপর অত্যাচার, অনিয়ম-দূর্নীতি ও অপরাধ কর্মকান্ডের যথাযথ বিচারের দাবীও তাদের।

তবে মাঝি আবু বক্কর বলেন, আমি মাঝি ঘাটের দায়িত্বে ছিলাম কিন্তু এখন নেই৷ স্থাণীয় একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও মনগড়া অভিযোগ করছে। মূলত আমি এখানে থাকলে প্রতিপক্ষরা অপকর্ম করার সুযোগ পায় না। সে কারণে এসব বানোয়াট, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। তিনি জাহাজে করে মাদক এনে এবং সুন্দরবনের হরিণ শিকার করে তা পাচার করাসহ অন্যদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়ার বিষয়ও তিনি অস্বীকার করেন। এছাড়া সে স্থাণীয় জনপ্রতিনিধি, কয়রা থানা ও নৌ পুলিশ, কাস্টমস অফিস, ইমিগ্রেশন অফিস, বন বিভাগের কর্মকর্তা, স্থানীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়মিত মাসিক উৎকোচ দিয়ে তার কর্মকান্ড পরিচালনার দাবি করেন।

খুলনা কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মো. বেলাল হোসেন বলেন, ৪-৫ বছর আগে মাঝির কাজ থেকে আবু বক্করকে বাদ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারসহ বেশ কিছু অনিয়ম দূর্নীতির ও প্রতারণার লিখিত অভিযোগ পেয়ে আঞ্চলিক অফিস সুপার লুৎফর রহমান গাজীকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খুলনার কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মো. আতিকুর রহমান জানান, আংটিহারা কাস্টমস ষ্টেশনের সাবেক মাঝি আবু বক্কর গাজীর অনিয়ম দূর্নীতির বিষয়ে ইতিপূর্বে তদন্তে প্রমাণ পাওয়ায় ৪-৫ বছর আগে মাঝির কাজ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারসহ বেশ কিছু অনিয়ম দূর্নীতির ও প্রতারণার লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ইতিমধ্যেই অফিসের বাউন্ডারীর পকেট গেট বন্ধসহ মাঝি বক্করকে কাস্টমস অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। একই সাথে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবনের ২টি কক্ষ দখল করে বক্কর মাঝির নিয়ন্ত্রনাধীন চোরাই জ¦ালানী তেল ও মাদক ব্যবসার গোডাউনটিও উচ্ছেদ করা হয়েছে।এ বিষয়ে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি জানান।  ##