১০:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চলতি বছরের অক্টোবরেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র

  • সংবাদদাতা
  • প্রকাশিত সময় : ০৭:৫০:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • ১০৮ পড়েছেন

বিশেষ প্রতিবেদক, খুলনা।।

বহুল আলোচিত-সমালোচিত বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবশেষে সফলতায় পৌছাচ্ছে।দেশী-বিদেশী পরিবেশবাদীদের নানামুখী অপপ্রচার ও বাধা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই অক্টোবর মাসেই বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র “মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট”। ইতোমধ্যেই এ কেন্দ্রের পরীক্ষামূলক উৎপাদন প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বানিজ্যিক উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে তাই প্রকল্প এলাকাজুড়ে চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি। দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সাফল্যের এ সুর্বনক্ষনে কোন কাজই যেন অসম্পন্ন না থাকে সেগুলোও পুংখানুপুংখভাবে যাচাই করে দেখা হচ্ছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বানিজ্যিক উৎপাদনের এখনও দিন ক্ষণ চুড়ান্ত করা না হলেও অক্টোবরের যে কোন দিন শুরু করা হবে বানিজ্যিক উৎপাদন এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের(বিআইএফপিসিএল) প্রকল্প পরিচালক সুভাস চন্দ্র পান্ডে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, “রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রে দুটি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিটের মাধ্যমে অক্টোবর মাসেই বাণিজ্যিকভাবে ৬৬০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারব। এ লক্ষ্যে গত ১৫অগাস্ট পরীক্ষামুলক ৯১মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। ইতোমধ্যে খুলনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া গত ৬এপ্রিল পাওয়ার প্লান্টটির ৪০০কেভি জিআইএস সুইচ ইয়ার্ড এবং আন্তঃসংযোগকারী ট্রান্সফরমারকে সক্রিয় করা হয়েছিল। ফলে এটি পায়রা পাওয়ার প্রজেক্ট থেকে বাংলাদেশের ২৩০কেভি গ্রিড সিস্টেমে ৪০০কেভি বিদ্যুতের হুইলিং ফ্যাসিলিটি প্রদান করছে। এতে বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন খুলনা অঞ্চলের সর্বোচ্চ চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রেরণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। যা খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য একটি বড় ধরনের সুবিধা বলেও মনে করছেন প্রকল্প পরিচালক।

সরেজমিন দেখা গেছে, রামপালে নির্মিত কয়লা ভিত্তিক মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট ৬৬০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিটের জন্য পৃথকভাবে তৈরী করা হয়েছে। যার মধ্যে ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ হিসেবে সনাক্ত করা রয়েছে। দুটি ইউনিটের মাধ্যমে দেশের দুই অঞ্চলে এই প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। আগামী বছরের মার্চ মাসে কেন্দ্রের ইউনিট-২ এর আরও ৬৬০মেগাওয়াট উৎপাদনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরো সক্ষমতার ১হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। ইতোমধ্যেই পুরো প্রকল্পের কাজ ৮২দশমিক ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান। রামপালের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে দেশী কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। সেজন্য বিদ্যুৎ তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসাবে নির্ভর করতে হবে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিশেষ গ্রেডের এই কয়লার উপর। যা আমদানি করতে হবে ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার দেশ বা মোজাম্বিক থেকে।এখন ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ব্যবহার করেই ট্রায়াল উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫৫হাজার মেট্রিক টন কয়লা মোংলায় পৌছেছে।কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জন্য তিন লাখ মেট্রিক টন কয়লা আমদানীর চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নদীর তীরে একপাশে ঘন্টায় ৩হাজার ৬শ টন কয়লা আনলোডের সক্ষমতা নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পৃথক জেটি।  উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেইনের মাধ্যমে কয়লা সরাসরি কনভেয়ার বেল্টে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বয়লার ও চারটি অভ্যন্তরীন শেডে পৌছানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আড়াই লাখ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন চারটি শেডে মোট ১০লাখ টন কয়লা মজুদ করা যাবে। যা একটানা তিন মাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রাখবে। ৯১৫একর জমির সীমানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পশুর নদের তীরে নির্মাণ হওয়ায় এ কেন্দ্রের বয়লার ঠাণ্ডা ও উচ্চ চাপ তৈরি করতে এ নদী থেকেই প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করা হবে বলে জানান কর্মকর্তারা।

প্রকল্প পরিচালক সুভাস চন্দ্র পান্ড আরও জানান, কেন্দ্রটি পুরোদমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে প্ল্যান্টের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার সময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে প্রায় ৪৫০গ্রাম কয়লা প্রয়োজন হবে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণের উপর নির্ভর করবে কয়লার কি পরিমান ব্যবহার হবে। কেন্দ্রটি শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করবে। কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুতের বিতরণ মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার। তবে এই কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম বিশ্ববাজারের কয়লার মূল্যের উপর নির্ভর করবে অনেকটাই।

জানা গেছে, দেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে ২০১০সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই ‍চুক্তির আওতায় ২০১০ সালেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক হাজার ৩২০মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানে চুক্তি হয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে জায়গা হিসেবে চূড়ান্ত করা হয় বাগেরহাটের রামপালের পশুর নদীর তীরে কৈগরদাশকাঠি, সাপমারী ও কাটাখালী মৌজা। ২০১০সালেই এক  হাজার ৮৩৪একর জমি অধিগ্রহণের কাজও শুরু হয়। কিন্তু স্থানীয়দের পাশাপাশি পরিবেশবাদী সংগঠন, তেল-গ্যাস-বন্দর ও বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং খুলনার  নাগরিক আন্দোলন অভিযোগ করে। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে সুন্দরবন ও কৃষি জমিক্ষতিগ্রস্ত হবে ধোয়া তুলে প্রকল্প বাতিলের জন্য তখন থেকেই আন্দোলন শুরু করে।এতে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। তবে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মানের পক্ষে সরকার ও স্তানীয় কিছু জন্রপতিনিধি যৌক্তিকতা তুলে ধরে পক্ষে অবস্থান নেয়। সরকারের পক্ষ থেকেও পরিবেশের ক্ষতি ন্যূনতম মাত্রায় রেখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২০সালের নির্দিষ্ঠ সময়ের  মধ্যে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মান কাজ শেষ হওয়ার কতা থাকলেও নানান জটিলতায় পিছিয়ে যায়। সব শেষ আগামী অক্টোবরেই বানিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।

পরিবেশবাধীদের অভিযোগের বিষয়ে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, এখানে ধোঁয়া নির্গমনে ২৭৫মিটার উচ্চতার চিমনি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেন পরিবেশের উপর ঝুঁকির মাত্রা সর্বনিম্ন থাকে। এছাড়া বাতাসে ধোঁয়া ছাড়ার আগে এফজিডি(দ্য ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন) সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে বয়লার থেকে বের হওয়া ক্ষতিকর সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস আর বাইরে যাবে না। তা পিউরিফাই(পরিশোধন) হয়ে চিমনির বাইরে বের হয়ে বাতাসে মিশবে, যা বাতাসকে দূষণ করবে না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এছাড়া বিদুৎ কেন্দ্রটিতে ব্যবহৃত হওয়ার পর গরম পানি পশুর নদীতে ফেলার আগে ঠাণ্ডা করা হবে, যাতে নদীর পানির গুণাগুণ অক্ষত থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্টটি ভারত সরকারের রেয়াতযোগ্য অর্থায়ন প্রকল্প। ভারতের হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড(বিএইচইএল) কোম্পানী কর্তৃক বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানীর(বিআইএফপিসিএল) অধিনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।যা ভারতের এনটিপিসি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড উভয়ের ৫০শতাংশ করে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানী। প্রকল্পটি নির্মাণে ব্যয় ২বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মোংলা-খুলনা মহাসড়কের পাশে রামপাল উপজেলার সাপমারী-কাটাখালী ও কৈর্গদাশকাঠী এলাকায় ১হাজার ৮৩৪ একর জমির উপর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর ২০১২ সালে ২৯ জানুয়ারি দুই দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানী বিপিডিবি ও এনপিপিসি যৌথ কোম্পানি গঠন করে। ২০১৩ সালে ১আগস্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়। ২০১৫ সালের ১২ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহবান করা হয়। ২০১৬ সালের ১২জুলাই ভারত হেভি ইলেট্রিক্যালস লিমিটেডের(বিএইচইএল) সাথে চুক্তি সাক্ষর হয়।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, দুই দেশের যৌথ বিনিয়োগে এখন একটি সফল ও যুগোপযোগী উদ্যোগ। এটি চালু হলে সারা দেশের ন্যায় খুলনা অঞ্চলের মানুষও বিদ্যুতের সুফল ভোগ করবে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটার পাশাপাশি এই প্রকল্পের ফলে এ অঞ্চলের হাজারও মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। যারা বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ক্ষতি হবে, ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আন্দোলন করে বাতিল করার কথা বলেছিল তারাও বিদুতের সুবিধা ভোগ করবেন। কাজেই দেশের মানুষের কল্যানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ণ প্রকল্পের জন্য আর বিরোধীতা নয়-সহযোগীতা করুন তবেই দেশের ও মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ণ ঘটবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিজ্যিক উৎপাদনে গেলে খুলনাসহ এই অঞ্চলে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে। কৃষিতে সেচসহ নানান কাজে বিদ্যূতের ঘাটতি পুরন হবে এবং ব্যবসা বানিজ্যের প্রসারসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ণ ত্বরান্বিত হয়ে সার্বিক চিত্র পাল্টে যাবে। তাই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য আশির্বাদ স্বরূপ বলে মনে করেন এই বর্ষীয়ান রাজৈনীতিক ও জনপ্রতিনিধি। ##

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

Dainik Madhumati

জনপ্রিয়

কোস্টগার্ডের অভিযানে অস্ত্রসহ আটক -১ 

চলতি বছরের অক্টোবরেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র

প্রকাশিত সময় : ০৭:৫০:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২২

বিশেষ প্রতিবেদক, খুলনা।।

বহুল আলোচিত-সমালোচিত বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবশেষে সফলতায় পৌছাচ্ছে।দেশী-বিদেশী পরিবেশবাদীদের নানামুখী অপপ্রচার ও বাধা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই অক্টোবর মাসেই বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র “মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট”। ইতোমধ্যেই এ কেন্দ্রের পরীক্ষামূলক উৎপাদন প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বানিজ্যিক উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে তাই প্রকল্প এলাকাজুড়ে চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি। দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সাফল্যের এ সুর্বনক্ষনে কোন কাজই যেন অসম্পন্ন না থাকে সেগুলোও পুংখানুপুংখভাবে যাচাই করে দেখা হচ্ছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বানিজ্যিক উৎপাদনের এখনও দিন ক্ষণ চুড়ান্ত করা না হলেও অক্টোবরের যে কোন দিন শুরু করা হবে বানিজ্যিক উৎপাদন এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের(বিআইএফপিসিএল) প্রকল্প পরিচালক সুভাস চন্দ্র পান্ডে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, “রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রে দুটি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিটের মাধ্যমে অক্টোবর মাসেই বাণিজ্যিকভাবে ৬৬০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারব। এ লক্ষ্যে গত ১৫অগাস্ট পরীক্ষামুলক ৯১মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। ইতোমধ্যে খুলনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া গত ৬এপ্রিল পাওয়ার প্লান্টটির ৪০০কেভি জিআইএস সুইচ ইয়ার্ড এবং আন্তঃসংযোগকারী ট্রান্সফরমারকে সক্রিয় করা হয়েছিল। ফলে এটি পায়রা পাওয়ার প্রজেক্ট থেকে বাংলাদেশের ২৩০কেভি গ্রিড সিস্টেমে ৪০০কেভি বিদ্যুতের হুইলিং ফ্যাসিলিটি প্রদান করছে। এতে বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন খুলনা অঞ্চলের সর্বোচ্চ চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রেরণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। যা খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য একটি বড় ধরনের সুবিধা বলেও মনে করছেন প্রকল্প পরিচালক।

সরেজমিন দেখা গেছে, রামপালে নির্মিত কয়লা ভিত্তিক মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট ৬৬০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিটের জন্য পৃথকভাবে তৈরী করা হয়েছে। যার মধ্যে ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ হিসেবে সনাক্ত করা রয়েছে। দুটি ইউনিটের মাধ্যমে দেশের দুই অঞ্চলে এই প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। আগামী বছরের মার্চ মাসে কেন্দ্রের ইউনিট-২ এর আরও ৬৬০মেগাওয়াট উৎপাদনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরো সক্ষমতার ১হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। ইতোমধ্যেই পুরো প্রকল্পের কাজ ৮২দশমিক ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান। রামপালের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে দেশী কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। সেজন্য বিদ্যুৎ তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসাবে নির্ভর করতে হবে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিশেষ গ্রেডের এই কয়লার উপর। যা আমদানি করতে হবে ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার দেশ বা মোজাম্বিক থেকে।এখন ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ব্যবহার করেই ট্রায়াল উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫৫হাজার মেট্রিক টন কয়লা মোংলায় পৌছেছে।কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জন্য তিন লাখ মেট্রিক টন কয়লা আমদানীর চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নদীর তীরে একপাশে ঘন্টায় ৩হাজার ৬শ টন কয়লা আনলোডের সক্ষমতা নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পৃথক জেটি।  উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেইনের মাধ্যমে কয়লা সরাসরি কনভেয়ার বেল্টে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বয়লার ও চারটি অভ্যন্তরীন শেডে পৌছানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আড়াই লাখ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন চারটি শেডে মোট ১০লাখ টন কয়লা মজুদ করা যাবে। যা একটানা তিন মাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রাখবে। ৯১৫একর জমির সীমানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পশুর নদের তীরে নির্মাণ হওয়ায় এ কেন্দ্রের বয়লার ঠাণ্ডা ও উচ্চ চাপ তৈরি করতে এ নদী থেকেই প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করা হবে বলে জানান কর্মকর্তারা।

প্রকল্প পরিচালক সুভাস চন্দ্র পান্ড আরও জানান, কেন্দ্রটি পুরোদমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে প্ল্যান্টের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার সময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে প্রায় ৪৫০গ্রাম কয়লা প্রয়োজন হবে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণের উপর নির্ভর করবে কয়লার কি পরিমান ব্যবহার হবে। কেন্দ্রটি শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করবে। কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুতের বিতরণ মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার। তবে এই কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম বিশ্ববাজারের কয়লার মূল্যের উপর নির্ভর করবে অনেকটাই।

জানা গেছে, দেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে ২০১০সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই ‍চুক্তির আওতায় ২০১০ সালেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক হাজার ৩২০মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানে চুক্তি হয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে জায়গা হিসেবে চূড়ান্ত করা হয় বাগেরহাটের রামপালের পশুর নদীর তীরে কৈগরদাশকাঠি, সাপমারী ও কাটাখালী মৌজা। ২০১০সালেই এক  হাজার ৮৩৪একর জমি অধিগ্রহণের কাজও শুরু হয়। কিন্তু স্থানীয়দের পাশাপাশি পরিবেশবাদী সংগঠন, তেল-গ্যাস-বন্দর ও বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং খুলনার  নাগরিক আন্দোলন অভিযোগ করে। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে সুন্দরবন ও কৃষি জমিক্ষতিগ্রস্ত হবে ধোয়া তুলে প্রকল্প বাতিলের জন্য তখন থেকেই আন্দোলন শুরু করে।এতে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। তবে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মানের পক্ষে সরকার ও স্তানীয় কিছু জন্রপতিনিধি যৌক্তিকতা তুলে ধরে পক্ষে অবস্থান নেয়। সরকারের পক্ষ থেকেও পরিবেশের ক্ষতি ন্যূনতম মাত্রায় রেখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২০সালের নির্দিষ্ঠ সময়ের  মধ্যে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মান কাজ শেষ হওয়ার কতা থাকলেও নানান জটিলতায় পিছিয়ে যায়। সব শেষ আগামী অক্টোবরেই বানিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।

পরিবেশবাধীদের অভিযোগের বিষয়ে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, এখানে ধোঁয়া নির্গমনে ২৭৫মিটার উচ্চতার চিমনি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেন পরিবেশের উপর ঝুঁকির মাত্রা সর্বনিম্ন থাকে। এছাড়া বাতাসে ধোঁয়া ছাড়ার আগে এফজিডি(দ্য ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন) সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে বয়লার থেকে বের হওয়া ক্ষতিকর সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস আর বাইরে যাবে না। তা পিউরিফাই(পরিশোধন) হয়ে চিমনির বাইরে বের হয়ে বাতাসে মিশবে, যা বাতাসকে দূষণ করবে না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এছাড়া বিদুৎ কেন্দ্রটিতে ব্যবহৃত হওয়ার পর গরম পানি পশুর নদীতে ফেলার আগে ঠাণ্ডা করা হবে, যাতে নদীর পানির গুণাগুণ অক্ষত থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্টটি ভারত সরকারের রেয়াতযোগ্য অর্থায়ন প্রকল্প। ভারতের হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড(বিএইচইএল) কোম্পানী কর্তৃক বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানীর(বিআইএফপিসিএল) অধিনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।যা ভারতের এনটিপিসি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড উভয়ের ৫০শতাংশ করে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানী। প্রকল্পটি নির্মাণে ব্যয় ২বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মোংলা-খুলনা মহাসড়কের পাশে রামপাল উপজেলার সাপমারী-কাটাখালী ও কৈর্গদাশকাঠী এলাকায় ১হাজার ৮৩৪ একর জমির উপর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর ২০১২ সালে ২৯ জানুয়ারি দুই দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানী বিপিডিবি ও এনপিপিসি যৌথ কোম্পানি গঠন করে। ২০১৩ সালে ১আগস্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়। ২০১৫ সালের ১২ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহবান করা হয়। ২০১৬ সালের ১২জুলাই ভারত হেভি ইলেট্রিক্যালস লিমিটেডের(বিএইচইএল) সাথে চুক্তি সাক্ষর হয়।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, দুই দেশের যৌথ বিনিয়োগে এখন একটি সফল ও যুগোপযোগী উদ্যোগ। এটি চালু হলে সারা দেশের ন্যায় খুলনা অঞ্চলের মানুষও বিদ্যুতের সুফল ভোগ করবে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটার পাশাপাশি এই প্রকল্পের ফলে এ অঞ্চলের হাজারও মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। যারা বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ক্ষতি হবে, ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আন্দোলন করে বাতিল করার কথা বলেছিল তারাও বিদুতের সুবিধা ভোগ করবেন। কাজেই দেশের মানুষের কল্যানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ণ প্রকল্পের জন্য আর বিরোধীতা নয়-সহযোগীতা করুন তবেই দেশের ও মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ণ ঘটবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিজ্যিক উৎপাদনে গেলে খুলনাসহ এই অঞ্চলে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে। কৃষিতে সেচসহ নানান কাজে বিদ্যূতের ঘাটতি পুরন হবে এবং ব্যবসা বানিজ্যের প্রসারসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ণ ত্বরান্বিত হয়ে সার্বিক চিত্র পাল্টে যাবে। তাই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য আশির্বাদ স্বরূপ বলে মনে করেন এই বর্ষীয়ান রাজৈনীতিক ও জনপ্রতিনিধি। ##