১০:১০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ :

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

###    “আজ অগ্নিঝরা মার্চের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ।” বাঙালির যৌক্তিক স্বাধীনতার স্বপ্নপুরণের যাত্র শুরু। ৬ই মার্চ পাকিস্তানের এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পুনরায় দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরিস্থিতি রক্ষা করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয় আগামীকাল বক্তৃতায় জানতে পারবেন।’ এরপর থেকেই সমগ্র বাঙালীর- ঐতিহাসিক ৭ মার্চে’র বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনার অধীর আগ্রহ ও অপেক্ষায় অবসান হয় আজ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণ হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এক ও অবিচ্ছেদ্য বিষয়। স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর কাছে কোনো আকস্মিক বিষয় ছিল না, বরং ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনিবার্য জাতীয় স্বাধীনতার দিকে তিনি বাংলার জনগণকে প্রস্তুত করেছিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এই ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্যে যেমন দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার কথা অন্তভুক্তর্, তেমনি বাঙালী জাতির সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণের আকাঙ্খা ধারণ করেছে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। বিশে^ আজ এ ভাষণ একটি ‘ঐশি^ক যৌক্তিক মহা কাব্য’। এর তুলনা ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালির হাজার বছরের দুঃখ-বেদনা, বঞ্চনা এবং ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে থাকার ইতিহাস; সমগ্র বাঙালীজাতির বিদ্রোহ বারুদ ঠাসা সচেতন-অবচেতন মনের অব্যক্ত ভাষা আজ বঙ্গবন্ধুর ভাষনের মধ্যদিয়ে প্রকাশ হয়েছিল। এ দিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ই মার্চে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে পড়ে। একইভাবে এ ভাষণ শুধু রাজনৈতিক দলিলই নয়, জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় বিধানের একটি সম্ভাবনাও তৈরি করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো।
১৯৭১’র আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে। তখন পুরো ঢাকার রেসকোর্স ময়দান লাখ লাখ বাঙালির শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। মাত্র ১৮-১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জনগণের প্রতি আজ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ: এক. বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ রাখুন। দুই. সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট- সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। কোথাও শিথিল করা হইলে জানানো হবে। তিন. রিকশা, বাস-ট্যাক্সি প্রভৃতি এবং রেলগাড়ি ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন। কিন্তু জনগণের ওপর জুলুম চালাবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের কাজে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করবেন না। সেক্ষেত্রে তাদের চলাচলের ব্যাপারে কোনও কিছু ঘটলে আমি দায়ী হবো না। চার. বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করবেন এবং গণআন্দোলনের কোনও খবর গায়েব করবেন না। যদি তাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা কাজে যোগ দিবেন না। পাঁচ. শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন। ছয়. স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন। সাত. সকল গৃহশীর্ষে প্রতিদিন কালো পতাকা উড্ডয়মান রাখুন। আট. ব্যাংকগুলো প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। নয়. অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হইলো। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে যে কোনও সময় আবার অংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা হতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত থাকুন। দশ. স্থানীয় আওয়ামী লীগ শাখার নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন। জতিয় অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর চার শর্ত: এক. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, দুই. সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, তিন. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা, চার. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এছাড়াও দেশব্যাপী গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন স্থানে সংঘঠিত হত্যাকা-ের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর অন্যতম সদস্য তোফায়েল আহমেদ সেদিনের স্মৃতিচারন করে সংবাদিকদের বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তার চশমাটা সেদিন ডায়াসের ওপর রেখে ১৮ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার পুরোটাই অলিখিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট দিকনিদের্শনা ছিল। সে মোতাবেক আমরা কাজ করেছি।
খুলনায় দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন উপলক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচির আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। ৭ মার্চ সকাল ৮ টায় শহিদ হাদিস পার্ক থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি শুরু হয়ে খুলনা কালেক্টরেট প্রাঙ্গণে অবস্থিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ৭ই মার্চে প্রদত্ত ভাষণ প্রচার করা হবে। জাতীয় কর্মসূচির সাথে সঙ্গতি রেখে দিবসটি উপলক্ষ্যে জেলার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করবে। সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে আলোকসজ্জা ও ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ সম্বলিত তোরণ স্থাপন করা হয়েছে। ৭ মার্চ সকাল ১০টায় খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। ৬ মার্চ সকাল সাড়ে নয়টায় শিশু একাডেমির খুলনা জেলা কার্যালয়ে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষ্যে জেলা স্টেডিয়ামে বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর সাজে-সজ্জিত হয়ে ১৯২০ জন ক্ষুদে বক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ পরিবেশন করবে। এ দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সিটি কর্পোরেশন, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদসমূহ সহ আওয়ামী লীগ দিবসটি উদযাপন করবে। এছাড়া, সকল সংবাদমাধ্যম ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে।##

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

Dainik adhumati

জনপ্রিয়

কোস্টগার্ডের অভিযানে অস্ত্রসহ আটক -১ 

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ :

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

প্রকাশিত সময় : ১২:৩১:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ মার্চ ২০২৩

###    “আজ অগ্নিঝরা মার্চের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ।” বাঙালির যৌক্তিক স্বাধীনতার স্বপ্নপুরণের যাত্র শুরু। ৬ই মার্চ পাকিস্তানের এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পুনরায় দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরিস্থিতি রক্ষা করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয় আগামীকাল বক্তৃতায় জানতে পারবেন।’ এরপর থেকেই সমগ্র বাঙালীর- ঐতিহাসিক ৭ মার্চে’র বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনার অধীর আগ্রহ ও অপেক্ষায় অবসান হয় আজ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণ হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এক ও অবিচ্ছেদ্য বিষয়। স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর কাছে কোনো আকস্মিক বিষয় ছিল না, বরং ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনিবার্য জাতীয় স্বাধীনতার দিকে তিনি বাংলার জনগণকে প্রস্তুত করেছিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এই ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্যে যেমন দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার কথা অন্তভুক্তর্, তেমনি বাঙালী জাতির সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণের আকাঙ্খা ধারণ করেছে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। বিশে^ আজ এ ভাষণ একটি ‘ঐশি^ক যৌক্তিক মহা কাব্য’। এর তুলনা ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালির হাজার বছরের দুঃখ-বেদনা, বঞ্চনা এবং ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে থাকার ইতিহাস; সমগ্র বাঙালীজাতির বিদ্রোহ বারুদ ঠাসা সচেতন-অবচেতন মনের অব্যক্ত ভাষা আজ বঙ্গবন্ধুর ভাষনের মধ্যদিয়ে প্রকাশ হয়েছিল। এ দিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ই মার্চে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে পড়ে। একইভাবে এ ভাষণ শুধু রাজনৈতিক দলিলই নয়, জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় বিধানের একটি সম্ভাবনাও তৈরি করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো।
১৯৭১’র আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে। তখন পুরো ঢাকার রেসকোর্স ময়দান লাখ লাখ বাঙালির শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। মাত্র ১৮-১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জনগণের প্রতি আজ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ: এক. বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ রাখুন। দুই. সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট- সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। কোথাও শিথিল করা হইলে জানানো হবে। তিন. রিকশা, বাস-ট্যাক্সি প্রভৃতি এবং রেলগাড়ি ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন। কিন্তু জনগণের ওপর জুলুম চালাবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের কাজে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করবেন না। সেক্ষেত্রে তাদের চলাচলের ব্যাপারে কোনও কিছু ঘটলে আমি দায়ী হবো না। চার. বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করবেন এবং গণআন্দোলনের কোনও খবর গায়েব করবেন না। যদি তাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা কাজে যোগ দিবেন না। পাঁচ. শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন। ছয়. স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন। সাত. সকল গৃহশীর্ষে প্রতিদিন কালো পতাকা উড্ডয়মান রাখুন। আট. ব্যাংকগুলো প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। নয়. অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হইলো। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে যে কোনও সময় আবার অংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা হতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত থাকুন। দশ. স্থানীয় আওয়ামী লীগ শাখার নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন। জতিয় অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর চার শর্ত: এক. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, দুই. সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, তিন. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা, চার. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এছাড়াও দেশব্যাপী গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন স্থানে সংঘঠিত হত্যাকা-ের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর অন্যতম সদস্য তোফায়েল আহমেদ সেদিনের স্মৃতিচারন করে সংবাদিকদের বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তার চশমাটা সেদিন ডায়াসের ওপর রেখে ১৮ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার পুরোটাই অলিখিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট দিকনিদের্শনা ছিল। সে মোতাবেক আমরা কাজ করেছি।
খুলনায় দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন উপলক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচির আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। ৭ মার্চ সকাল ৮ টায় শহিদ হাদিস পার্ক থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি শুরু হয়ে খুলনা কালেক্টরেট প্রাঙ্গণে অবস্থিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ৭ই মার্চে প্রদত্ত ভাষণ প্রচার করা হবে। জাতীয় কর্মসূচির সাথে সঙ্গতি রেখে দিবসটি উপলক্ষ্যে জেলার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করবে। সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে আলোকসজ্জা ও ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ সম্বলিত তোরণ স্থাপন করা হয়েছে। ৭ মার্চ সকাল ১০টায় খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। ৬ মার্চ সকাল সাড়ে নয়টায় শিশু একাডেমির খুলনা জেলা কার্যালয়ে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষ্যে জেলা স্টেডিয়ামে বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর সাজে-সজ্জিত হয়ে ১৯২০ জন ক্ষুদে বক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ পরিবেশন করবে। এ দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সিটি কর্পোরেশন, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদসমূহ সহ আওয়ামী লীগ দিবসটি উদযাপন করবে। এছাড়া, সকল সংবাদমাধ্যম ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে।##