![](https://dainikmadhumati.com/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
### বামপন্থী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, মার্কসবাদী পন্ডিত ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড রতন সেনের জন্ম শতবর্ষ পূর্ণ হল আজ ০৩এপ্রিল। তিনি ১৯২৩ সালের এদিনে বৃহত্তর বরিশালের উজিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। চোখে চশমা, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পড়নে সাদা পায়জামা পড়তেন। পেশায় ছিলেন শিক্ষক। লেখায় ছিলেন পারদর্শী। ইংরেজী বই আর পত্র-পত্রিকা পড়ে দিনের শুরুটা কাটাতেন। সাপ্তাহিক একতা, মুক্তির দিগন্তসহ অনেক পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত ছাপা হতো। চিরায়িত মার্কসবাদ ছাড়া চলতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী নিয়ে তিনি পত্রিকায় লিখতেন। তা থেকে অর্থ উপার্জন করেছে কম নয়। মুক্তির দিগন্তের লেখা তিনি ইংরেজি পত্রিকা থেকে অনুবাদ করতেন। তিনি ‘প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী’ ও ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’ নামে দুটি বই অনুবাদ করেন। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন চিরকুমার। অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। তাঁর সংগ্রহে অনেক বই ছিল কিন্তু রাখার কোনো সেলফ ছিল না। ১০ কি.মি. পথ একসময় হেঁটে, পরবর্তীতে সাইকেল ও ভ্যানে করে পার্টি অফিসে আসতেন। চিরকুমার কমরেড রতন সেন মার্কসবাদী পন্ডিত হিসাবে চমৎকার আলোচনা করতেন। তবে জনসম্মুখে বক্তৃতা করতেন কম। কৃষক-মেহনতি মানুষকে তিনি ভালবাসতেন। ধর্ম ছিল মানবসেবা। ভোজনবিলাসি ছিলেন না বললেই চলে। নিজে রান্না করে খেতে বেশ পচ্ছন্দ করতেন। সকালের খাবারে রুটি আর সন্দেশ হলেই চলে যেতো তার। চায়ে চিনি খেতেন খুব বেশি। তাই পার্টি অফিসের সামনের চায়ের দোকানে রতন দার চা বললে কাগজে মুড়ে দিতেন চিনি। দুপুরের খাবারটা অধিকাংশ সময় আসতো কমরেডদের বাড়ি থেকে। তবে বেশির ভাগ সময় খাবার আসতো ডাঃ মাহাবুবর রহমানের বাড়ি থেকে। রাতে রাড়ি ফেরে রান্না করে খেতেন। পাটির কাজে বাইরে যাওয়া ছাড়া বেশি সময় কাটাতেন পার্টি অফিসে। মেজাজ ছিল বেজয়, তবে হৃদয় ছিল কমল। ধমক খাইনি এমন লোক কম আছে। সিদ্ধান্তে ছিল অটল। কর্মীদের সংকটে সমাধান দিতে সর্বক্ষনিক কাজ করতেন। মাঝে মধ্যে হেমিও চিকিৎসাও দিতেন তিনি ।
কমরেড রতন সেনের পিতার নাম ছিল নরেন্দ্র্রনাথ সেনগুপ্ত। তিনি ছিলেন দৌলতপুর বি এল কলেজের প্রধান অফিস সহকারী। সে সুবাদে রতন সেনের শৈশব-কৈশোর কেটেছে দৌলতপুরে। তিনি দৌলতপুর মহসীন স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে দৌলতপুর একাডেমিতে (বি এল কলেজ) ভর্তি হন। বি এল কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিএ অনার্স (ইংরেজি)-তে ভর্তি হন। ছাত্র আন্দোলনের কারণে গ্রেফতার হওয়ায় তিনি জেলে বসে ১৯৪২ সালে ডিস্টিংশনসহ বি এ পাস করেন। স্কুলজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। শুরুটা করেন দৌলতপুর মহসীন স্কুলে ছাত্রাবস্থায়। যোগ দেন নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতিতে। পরবর্তীকালে সমাজতন্ত্রে বিশ^াসী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হলে কাজ করতে শুরু করেন ছাত্র ফেডারেশনে। এই সময় তিনি বিএল কলেজে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। বড়ভাই মোহিত লাল সেনগুপ্ত তাকে এই পথে আসতে অনুপ্রাণিত করেন। কমরেড রতন সেন মার্কসবাদে দীক্ষা নিয়ে ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। প্রথমে শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৪৫ সালে পার্টির সিদ্ধান্তে বটিয়াঘাটার বয়ারভাঙ্গা বিশ্বম্ভর হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। উদ্দেশ্য গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করা। প্রতি শনিবার ১০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে তিনি খুলনা শহরে আসতেন এবং রবিবার খুলনায় থেকে পার্টি ও পার্টির পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’র জন্য কাজ করে সোমবার সকালে গিয়ে স্কুলে ক্লাস করতেন। তিনি ছিলেন ‘স্বাধীনতা’র খুলনার প্রতিনিধি। বটিয়াঘাটায় কৃষকদের নিয়ে তেভাগা আন্দোলন ও জমিদারীপ্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯৪৬ সালে খুলনা জেলার মৌভোগে প্রাদেশিক কিষাণ সভার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সারা প্রদেশ থেকে পাঁচশত প্রতিনিধি এবং প্রকাশ্য অধিবেশনে ত্রিশ হাজার কৃষক যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পার্টি ‘ইয়া আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখ ইনসান ভূখা হ্যায়’ স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম শুরু করলে পার্টির নেতা-কর্মীদের উপর নেমে আসে দমন-পীড়ন। ১৯৪৮ সালে খুলনার প্রখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডাঃ অতুল দাসের চেম্বার থেকে গ্রেফতার হন। এক পর্যায়ে তাঁকে রাখা হয় রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে। সেই সময়ে ওই জেলের কারা অন্তরালে ছিলেন ইলা মিত্র ও পশ্চিমবাংলার সাবেক মূখ্যমুন্ত্রী জ্যোতি বসু। ১৯৫৬ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে চলে আসেন রূপসার মৈশাঘুনি গ্রামে জেলসাথী কৃষকনেতা শান্তি ঘোষের বাড়িতে। এলাকাবাসীর অনুরোধে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আজগড়া হাই স্কুলে এবং পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। অল্প দিনে এলাকার মানুষের প্রিয় মাস্টার মহাশয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে কিছু দিনের মধ্যে দৌলতপুর রেল স্টেশন থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। খুলনা রেল স্টেশনে আনা হয় এবং সেখান থেকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে পুলিশের জিপ গাড়ির পিছনে বেঁধে টানতে টানতে খুলনা থানায় নিয়ে আসা হয়। মুক্তি পান ১৯৬৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের গণ-অভ্যুত্থানের সময়। ইতোমধ্যে পার্টির নেতাকর্মীরা মাওবাদের অনুসারি হয়ে পার্টি ত্যাগ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চের দিনগুলো তিনি খুলনা অঞ্চলের পার্টি কমরেডদের সংগঠিত করে ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে পাঠাতে থাকেন। ১১ এপ্রিল সহযোদ্ধা অমর কৃষকনেতা বিষ্ণু চ্যাটার্জী ঘাতক-দালালদের হাতে নিহত হওয়ার পর তিনি ভারতে চলে যান। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটে পানতোড়, পরে টাকী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান করেন। আশেপাশের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ছাত্র, যুবকদের সংগঠিত করে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিতেন।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পার্টির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। ১৯৮৯ সালে সভাপতির পদ সৃষ্টি হলে তিনি খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। কেন্দ্র্রীয় সম্পাদক থাকাকালে তিনি বেশকিছু দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। সে সময় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ, দলিল, ইস্তেহার রচনা করেন। কিন্তু বেশিদিন তাঁকে ঢাকায় ধরে রাখা যায়নি, ফিরে আসেন খুলনায়। স্বাধীনতার পর খুলনার হাট-ঘাট-নদীখাল, খাস জমি নিয়ে অসংখ্য আন্দোলনের তিনি নেতৃত্ব দেন। এক সময় দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষের নামে চলতে থাকে অত্যাচার-নিপীড়ন। শুরু হয় এলাকায় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। তিনি পার্টি-কৃষক সমিতি-জনগণকে সংগঠিত করেন শুরু করেন আন্দোলন। দাকোপ-বটিয়াঘাটা-পাইকগাছায় কিছু সাফল্য অর্জিত হয়। এ আন্দোলন দেশের বিবেকবান মানুষের নজর কাড়ে। জাতীয় সংসদে চিংড়ি চাষের নীতিমালা প্রণয়নের দাবি ওঠে। রতন সেন বলতেন, চিংড়ি চাষে এ মুহূর্তে হয়তো কৃষক লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এক সময় আসবে যখন চিংড়িও হবে না, ফসলও হবে না এবং পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। আজ রতন সেনের কথা সত্য হয়েছে।
১৯৯২ সালে দেশে গড়ে ওঠে একাত্তরের ঘাতক-দালাল বিরোধী আন্দোলন। ২৬ মার্চ গোলাম আযমের বিচার করা হয় গণ-আদালতে। এ সময়ে সরকার ২৪ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। খুলনায় ২৪ জনের বিরুদ্ধে দেয়া হয় মিথ্যা মামলা। এর মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তির মুখপত্র দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় খুলনার ঘাতক বিরোধী ৩৫ জন নেতবৃন্দকে কটাক্ষ করে ভারতের দালাল নামে পত্রিকায় তালিকা প্রকাশ করে। রতন সেন ছিলেন ঐ তালিকার শীর্ষে। তার দুই মাসের মধ্যে ৩১ জুলাই খুলনা ডিসি-এসপি অফিসের সামনে কমরেড রতন সেনকে নির্মমভাবে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। মৃত্যু হয়েছে রতন সেনর দেহের। চেতনা ধারন করে আজও বেঁচে আছে রতন সেনের অনুসারিরা। তাদের উদ্যোগে আজ সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে কমরেড রতন সেনের জন্ম শতবর্ষ অনুষ্ঠান । এটাও কম কি ? রতন সেনেরা বেঁচে আছে , বেঁচে থাকবে। থাকবে মার্কসবাদের চর্চ্চা। কমরেড রতন সেনের জন্ম শতবাষির্কীতে তাই রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: মহেন্দ্রনাথ সেন, সাধারন সম্পাদক, গুণীজন স্মৃতি পরিষদ।##