০১:০১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
‘অগ্নিঝরা মার্চ’র ১৩তম দিন :

চিত্রশিল্পী জয়নুল ও জাতীয় পরিষদ সদস্য আ: হাকিমের পাকিস্তান সরকারের খেতাব ও পদক বর্জন

###    ১৯৭১-এর ‘অগ্নিঝরা মার্চ’র ১৩তম দিন আজ। অগ্নিঝরা মার্চ বাঙালির যৌক্তিক স্বপ্নপুুরণের স্বাধীনতার মাস। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ’র মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭১ সালের এই মার্চেই রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে, একাত্তরের মার্চ মাসের দিনগুলো ছিল থমথমে, উৎকণ্ঠা, শঙ্কায় পরিপূর্ণ। চাপা উদ্বেগ, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। অবরুদ্ধ গণমানুষ ইতোমধ্যে প্রস্তুত চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। লক্ষ্য একটাই, নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। স্বাধীনতাকামী বাঙালির ঐক্য সুদৃঢ় হচ্ছিল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের ‘স্বাধীনতা’র দুর্বার আকাঙ্খার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। বাংগালীর ইতিহাসের ৭১’র আজকের দিনে পূর্ব বাংলার পেক্ষাপট পাল্টে যায় বঙ্গবন্ধুর সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ডাকে। ৭১’র অগ্নিঝরা মার্চের ১৩তম দিনের ঘটনাপ্রবাহে আপামর জনতার সাথে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়, প্রত্যয়, দৃঢ় একাত্মতা ঘোষণা করছিল স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন।
৭১’র এদিনে অসহযোগ আন্দোলনে দেশ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বত:ফুত অংশগ্রহণে বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে আরো তীব্রতা পায়। এ আন্দলোন ঠেকাতে পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৫নং সামরিক আদেশ জারি করে- ১৫ মার্চ সকাল ১০টা থেকে প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ- দেয়া হবে। সামরিক নির্দেশ জারির পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের প্রচ- দাবির কথা ঘোষণা করেছি, ঠিক তখন নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উসকানি দেয়ার শামিল।’ ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী সকালে করাচি থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্বতা ঘোষনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘বর্তমান সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমি খোলা মনে ঢাকায় এসেছি। সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে আমি তার সঙ্গে একমত।’
এদিন চট্টগ্রামে এক মহিলা সমাবেশে- বাংলাদেশের জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাস দ্রব্য বর্জন ও কালো ব্যাজ ধারণের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানান মহিলা নেত্রী বেগম উমরতুল ফজল । প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন। ঢাকাস্থ জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও তাদের পরিবারসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ বিমানে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের ত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারে সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। এদিন সিএ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, নৌপরিবহন, ডক, পাট ও সুতাকলের শ্রমিক সংগঠনগুলো, ছাত্র ইউনিয়ন মিছিল-সমাবেশ করে অসহযোগ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানায়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) প্রাঙ্গণে পরিষদের সব আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক, সম্পাদক ও সদস্যদের সভা আহ্বান করে। সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ লালবাগ আঞ্চলিক শাখার সভা হয়। ‘লেটার অব অথরিটি’ দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বন জানান সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির। তিনি অবিলম্বে পুর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষা বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবকটি ব্যাটালিয়নের পরিচালনার কর্তৃত্ব বাঙালি অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং বিগত এক মাসে পূর্ব বাংলায় যে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য আনা হয়েছে তাদের প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
১৯৭১ সালের মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলোয় এসে মুক্তিকামী বাঙালির উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনে দেশ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। এতে শঙ্কিত হয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের বাঘা বাঘা নেতাও শঙ্কিত হয়ে পড়েন।##

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

Dainik adhumati

জনপ্রিয়

সাতক্ষীরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মতবিনিময় সভা দু’গ্রুপের হাতাহাতিতে ভন্ডুল

‘অগ্নিঝরা মার্চ’র ১৩তম দিন :

চিত্রশিল্পী জয়নুল ও জাতীয় পরিষদ সদস্য আ: হাকিমের পাকিস্তান সরকারের খেতাব ও পদক বর্জন

প্রকাশিত সময় : ১০:০৮:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ মার্চ ২০২৩

###    ১৯৭১-এর ‘অগ্নিঝরা মার্চ’র ১৩তম দিন আজ। অগ্নিঝরা মার্চ বাঙালির যৌক্তিক স্বপ্নপুুরণের স্বাধীনতার মাস। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ’র মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭১ সালের এই মার্চেই রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে, একাত্তরের মার্চ মাসের দিনগুলো ছিল থমথমে, উৎকণ্ঠা, শঙ্কায় পরিপূর্ণ। চাপা উদ্বেগ, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। অবরুদ্ধ গণমানুষ ইতোমধ্যে প্রস্তুত চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। লক্ষ্য একটাই, নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। স্বাধীনতাকামী বাঙালির ঐক্য সুদৃঢ় হচ্ছিল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের ‘স্বাধীনতা’র দুর্বার আকাঙ্খার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। বাংগালীর ইতিহাসের ৭১’র আজকের দিনে পূর্ব বাংলার পেক্ষাপট পাল্টে যায় বঙ্গবন্ধুর সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ডাকে। ৭১’র অগ্নিঝরা মার্চের ১৩তম দিনের ঘটনাপ্রবাহে আপামর জনতার সাথে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়, প্রত্যয়, দৃঢ় একাত্মতা ঘোষণা করছিল স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন।
৭১’র এদিনে অসহযোগ আন্দোলনে দেশ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বত:ফুত অংশগ্রহণে বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে আরো তীব্রতা পায়। এ আন্দলোন ঠেকাতে পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৫নং সামরিক আদেশ জারি করে- ১৫ মার্চ সকাল ১০টা থেকে প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ- দেয়া হবে। সামরিক নির্দেশ জারির পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের প্রচ- দাবির কথা ঘোষণা করেছি, ঠিক তখন নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উসকানি দেয়ার শামিল।’ ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী সকালে করাচি থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্বতা ঘোষনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘বর্তমান সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমি খোলা মনে ঢাকায় এসেছি। সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে আমি তার সঙ্গে একমত।’
এদিন চট্টগ্রামে এক মহিলা সমাবেশে- বাংলাদেশের জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাস দ্রব্য বর্জন ও কালো ব্যাজ ধারণের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানান মহিলা নেত্রী বেগম উমরতুল ফজল । প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন। ঢাকাস্থ জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও তাদের পরিবারসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ বিমানে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের ত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারে সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। এদিন সিএ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, নৌপরিবহন, ডক, পাট ও সুতাকলের শ্রমিক সংগঠনগুলো, ছাত্র ইউনিয়ন মিছিল-সমাবেশ করে অসহযোগ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানায়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) প্রাঙ্গণে পরিষদের সব আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক, সম্পাদক ও সদস্যদের সভা আহ্বান করে। সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ লালবাগ আঞ্চলিক শাখার সভা হয়। ‘লেটার অব অথরিটি’ দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বন জানান সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির। তিনি অবিলম্বে পুর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষা বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবকটি ব্যাটালিয়নের পরিচালনার কর্তৃত্ব বাঙালি অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং বিগত এক মাসে পূর্ব বাংলায় যে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য আনা হয়েছে তাদের প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
১৯৭১ সালের মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলোয় এসে মুক্তিকামী বাঙালির উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনে দেশ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। এতে শঙ্কিত হয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের বাঘা বাঘা নেতাও শঙ্কিত হয়ে পড়েন।##