০৯:৫৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

থুতু ও প্রসাব খাওয়ায়ে দিত, কাজে দেড়ি হলে খুন্তি দিয়ে খোঁচাত

  • বাগেরহাট অফিস
  • প্রকাশিত সময় : ০৭:২৫:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ অক্টোবর ২০২২
  • ৫০ পড়েছেন

কাজে দেড়ি হলেই মোটা লাঠি দিয়ে পেটাতো। চামচ ও খুন্তি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে খোঁচা দিত। জোরপূর্বক থুতু ও প্রসাব খাওয়াতো আমাকে। বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে দিত না। শনিবার (০৮ অক্টোবর) এভাবেই গৃহকর্তার বাড়িতে নির্যাতনের কথা বলছিলেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রাবেয়া আক্তার ওরফে আকলিমা (১৭)।

নির্যাতনের শিকার রাবেয়া আক্তার ওরফে আকলিমা বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর বারইখালী গ্রামের সুলতান মোল্লার মেয়ে। ২০১৫ সালে মাত্র দশ বছর বয়সী রাবেয়াকে একই গ্রামের জালাল হাওলাদারের মাধ্যমে খুলনার নিরালা এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক এসএম সামছুল হকের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে পাঠায় তার বাবা-মা। সেখানে ৫ বছর কাজ করার পরে, রাবেয়াকে সিলেটে সামছুল হকের মেয়ে তানিয়া সুলতানা লাকির পাঠানো হয়। তিন মাস পরে রাবেয়াকে ঢাকার মিরপুরে ছোট বোন মেয়ে নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় পাঠিয়ে দেয় লাকি। এতদিন ভাল থকলেও, নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় আসার পরে অমানষিক নির্যাতন শুরু হয় রাবেয়ার উপর। তিন বছর নির্যাতন সহ্য করে, প্রাণ বাচাতে শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন নিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ৫ অক্টোবর লিজার ঢাকার বাসা থেকে পালিয়ে মোরেলগঞ্জে বাবার বাড়িতে চলে আসেন রাবেয়া। পরে শুক্রবার (০৭ অক্টোবর) বিকেলে মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় রাবেয়াকে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাবেয়ার হাত, পা, মুখমন্ডল, ঘাড়-পিঠসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। শারীরিকভাবে বেশ দুর্বলও সে।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শর্মী রায় বলেন, ওই কিশোরীর সারা শরীরেই ক্ষতচিহ্ন আছে। এগুলো বেশ পুরাতন। সার্প কাটিং কোন ক্ষত নেই। সবই বøাংক হুইপেন (লাঠি বা এই ধরণের কিছু) দিয়ে আঘাতের চিহ্ন বলে মনে হয়েছে। সে দুর্বলতা ও শরীরের ব্যথার কথা বলেছে। এখন শারীরিকভাবে সে ভালো আছে। তবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

হাসপাতালের বিছানায় বসে নির্যাতনের শিকার রাবেয়া বলেন, সামছুল হক স্যার ও তার বড় মেয়ে সবাই ভালো ছিল। কিন্তু তার ছোট মেয়ে অন্যরকম। প্রতিটা কাজে সময় বেধে দিত। একটু দেরি হলে বা ভুল হলেই মারধর, বকাবাকি করত। একদিন ওয়ারড্রপের উপর টিকটিকির মল পাওয়ায় আমাকে মুখ দিয়ে পরিস্কার করায়। আমার মা মারা গেলেও বাড়ি আসতে পরিনি। ওই ম্যাডামের স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর মাহফুজুর রহমান স্যারের পোস্টিংয়ের কারনে সৈয়দপুর, ঘাটাইল, সাভার, রংপুর হয়ে ঢাকার বাসায় কাজ করছি। কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক দেওয়া হত না। পেটে ভাতে কাজ করতাম। বড় করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে এমন কথা বলে অনেক ছোট বেলায় বাড়ি থেকে কাজে পাঠানো হয়েছিল।

রাবেয়া আরও বলেন, আমাকে প্রচুর মারধর করত। লাঠি, খুনতি দিয়ে পেটাত। দেওয়ালে মাথা টাক (আঘাত) দিত। সব সময় একটা ভয়ে থাকতাম। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে আমি পালায় আসছি। আমি আর কিছু চাইনা, আমার সাথে যা হয়েছে এমন যেন আর কারো এমন জীবনে না হয়। আমার মা নেই। মায়ের শেষ স্মৃতি একটা নাক ফুল আছে ওই বাসায়। আপনারা আমাকে ওইটা এনে দেন বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রাবেয়া।

রাবেয়ার বড় বোন হামিদা বেগম বলেন, বাবার দুই বিয়ে। প্রথম ঘরে আমরা চার বোন। পরের ঘরে ৭ বোন দুই ভাই। অভাবের কারনে ওকে কাজ দেই। বছরে এক দুই বার কথা হত। আমরা জানতামও রংপুরে আছে। ঢাকায় আছে এই কথা আমাদের জানানো হয়নি।

রাবেয়ার চাচা কাঞ্চন মোল্লা বলেন, ওর বাবা এখন এখন মৃত্যু শয্যায়। গত বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওর বাবার কাছে ফোন করে বলা হয় রাবেয়া ঢাকার বাসা থেকে পালাইছে। কিন্তু তার আগে আমাদের জানানোই হয়নি মেয়েটা ঢাকায়। মেয়ে বাড়িতে আসলে, আমরা ওসি সামছুল হক স্যারকে জানাই। তিনি এসে চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন এবং আরও ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমি এমন নির্যাতনের বিচার চাই।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক সামছুল হক বলেন, ‘রাবেয়া আমার মেয়ের বাসা থেকে অনেক মালামাল নিয়ে গত বুধবার পালিয়ে গেছে। মিরপুর থানায় জিডি করা হয়েছে। আপনারা শীঘ্রই মোরেলগঞ্জ থানার মাধ্যমে মেইল পেয়ে যাবেন’। এছাড়া আমার মেয়ে রাবেয়াকে মারধর করেছে তাই মানবিক কারনে মোরেলেগঞ্জে গিয়ে তার চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি’।

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

dainik madhumati

জনপ্রিয়

কোস্টগার্ডের অভিযানে অস্ত্রসহ আটক -১ 

থুতু ও প্রসাব খাওয়ায়ে দিত, কাজে দেড়ি হলে খুন্তি দিয়ে খোঁচাত

প্রকাশিত সময় : ০৭:২৫:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ অক্টোবর ২০২২

কাজে দেড়ি হলেই মোটা লাঠি দিয়ে পেটাতো। চামচ ও খুন্তি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে খোঁচা দিত। জোরপূর্বক থুতু ও প্রসাব খাওয়াতো আমাকে। বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে দিত না। শনিবার (০৮ অক্টোবর) এভাবেই গৃহকর্তার বাড়িতে নির্যাতনের কথা বলছিলেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রাবেয়া আক্তার ওরফে আকলিমা (১৭)।

নির্যাতনের শিকার রাবেয়া আক্তার ওরফে আকলিমা বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর বারইখালী গ্রামের সুলতান মোল্লার মেয়ে। ২০১৫ সালে মাত্র দশ বছর বয়সী রাবেয়াকে একই গ্রামের জালাল হাওলাদারের মাধ্যমে খুলনার নিরালা এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক এসএম সামছুল হকের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে পাঠায় তার বাবা-মা। সেখানে ৫ বছর কাজ করার পরে, রাবেয়াকে সিলেটে সামছুল হকের মেয়ে তানিয়া সুলতানা লাকির পাঠানো হয়। তিন মাস পরে রাবেয়াকে ঢাকার মিরপুরে ছোট বোন মেয়ে নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় পাঠিয়ে দেয় লাকি। এতদিন ভাল থকলেও, নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় আসার পরে অমানষিক নির্যাতন শুরু হয় রাবেয়ার উপর। তিন বছর নির্যাতন সহ্য করে, প্রাণ বাচাতে শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন নিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ৫ অক্টোবর লিজার ঢাকার বাসা থেকে পালিয়ে মোরেলগঞ্জে বাবার বাড়িতে চলে আসেন রাবেয়া। পরে শুক্রবার (০৭ অক্টোবর) বিকেলে মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় রাবেয়াকে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাবেয়ার হাত, পা, মুখমন্ডল, ঘাড়-পিঠসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। শারীরিকভাবে বেশ দুর্বলও সে।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শর্মী রায় বলেন, ওই কিশোরীর সারা শরীরেই ক্ষতচিহ্ন আছে। এগুলো বেশ পুরাতন। সার্প কাটিং কোন ক্ষত নেই। সবই বøাংক হুইপেন (লাঠি বা এই ধরণের কিছু) দিয়ে আঘাতের চিহ্ন বলে মনে হয়েছে। সে দুর্বলতা ও শরীরের ব্যথার কথা বলেছে। এখন শারীরিকভাবে সে ভালো আছে। তবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

হাসপাতালের বিছানায় বসে নির্যাতনের শিকার রাবেয়া বলেন, সামছুল হক স্যার ও তার বড় মেয়ে সবাই ভালো ছিল। কিন্তু তার ছোট মেয়ে অন্যরকম। প্রতিটা কাজে সময় বেধে দিত। একটু দেরি হলে বা ভুল হলেই মারধর, বকাবাকি করত। একদিন ওয়ারড্রপের উপর টিকটিকির মল পাওয়ায় আমাকে মুখ দিয়ে পরিস্কার করায়। আমার মা মারা গেলেও বাড়ি আসতে পরিনি। ওই ম্যাডামের স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর মাহফুজুর রহমান স্যারের পোস্টিংয়ের কারনে সৈয়দপুর, ঘাটাইল, সাভার, রংপুর হয়ে ঢাকার বাসায় কাজ করছি। কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক দেওয়া হত না। পেটে ভাতে কাজ করতাম। বড় করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে এমন কথা বলে অনেক ছোট বেলায় বাড়ি থেকে কাজে পাঠানো হয়েছিল।

রাবেয়া আরও বলেন, আমাকে প্রচুর মারধর করত। লাঠি, খুনতি দিয়ে পেটাত। দেওয়ালে মাথা টাক (আঘাত) দিত। সব সময় একটা ভয়ে থাকতাম। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে আমি পালায় আসছি। আমি আর কিছু চাইনা, আমার সাথে যা হয়েছে এমন যেন আর কারো এমন জীবনে না হয়। আমার মা নেই। মায়ের শেষ স্মৃতি একটা নাক ফুল আছে ওই বাসায়। আপনারা আমাকে ওইটা এনে দেন বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রাবেয়া।

রাবেয়ার বড় বোন হামিদা বেগম বলেন, বাবার দুই বিয়ে। প্রথম ঘরে আমরা চার বোন। পরের ঘরে ৭ বোন দুই ভাই। অভাবের কারনে ওকে কাজ দেই। বছরে এক দুই বার কথা হত। আমরা জানতামও রংপুরে আছে। ঢাকায় আছে এই কথা আমাদের জানানো হয়নি।

রাবেয়ার চাচা কাঞ্চন মোল্লা বলেন, ওর বাবা এখন এখন মৃত্যু শয্যায়। গত বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওর বাবার কাছে ফোন করে বলা হয় রাবেয়া ঢাকার বাসা থেকে পালাইছে। কিন্তু তার আগে আমাদের জানানোই হয়নি মেয়েটা ঢাকায়। মেয়ে বাড়িতে আসলে, আমরা ওসি সামছুল হক স্যারকে জানাই। তিনি এসে চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন এবং আরও ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমি এমন নির্যাতনের বিচার চাই।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক সামছুল হক বলেন, ‘রাবেয়া আমার মেয়ের বাসা থেকে অনেক মালামাল নিয়ে গত বুধবার পালিয়ে গেছে। মিরপুর থানায় জিডি করা হয়েছে। আপনারা শীঘ্রই মোরেলগঞ্জ থানার মাধ্যমে মেইল পেয়ে যাবেন’। এছাড়া আমার মেয়ে রাবেয়াকে মারধর করেছে তাই মানবিক কারনে মোরেলেগঞ্জে গিয়ে তার চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি’।