০৯:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৩১ মার্চ ১৯৭১:

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে ভারতের সমর্থন

###     অগ্নিঝরা মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পাঁচ দিন পর। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি জানিয়ে আজকের দিনে ভারতের পার্লামেন্টের লোকসভা ও রাজ্যসভা একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এদিকে সারাদেশের মতো কুষ্টিয়ায় আফতাব উদ্দিন খানের বাহিনী স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ লোকসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তোলা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্মম হত্যাকা- বন্ধে পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করতে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ‘পূর্ব বাংলা সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব’ এ বলা হয়েছিল, “পূর্ব বাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের অভ্যুত্থান সফল হবে। এই পার্লামেন্ট আশা করে এবং নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে তাদের লড়াই ও ত্যাগ ভারতের জনগণের সর্বাত্মক সহানুভূতি ও সমর্থন পাবে।” এদিনে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে লক্ষাধিক শরণার্থী বিভিন্ন পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এদিন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সেখানকার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাদের সার্বিক সহায়তা করেন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার গার্ড অব অনার দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধির মর্যাদায় প্রদান করেন। আগের দিন কালুরঘাটে পাকিস্তান বাহিনীর বিমান হামলার পর এদিন চট্টগ্রাম থেকে এক কিলোওয়াট সম্পন্ন ট্রান্সমিটার প্রথমে পটিয়া নেওয়া হয়। পরে সীমান্ত পার করে ভারতের আগরতলায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার প্রচারণা চলতে থাকে। একাত্তর সালের ৩১ মার্চ চট্টগ্রামের হালিশহরে নাথপাড়ায় পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বিহারিরা এ হত্যাকা- চালায়। তারা অল্প সময়ের মধ্যে কুড়াল, কিরিচ ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে ৪০ জন ইপিআরসহ ৭৯ জনকে হত্যা করে। ঢাকার নারিন্দা মঠে হামলা চালায় পাকিস্তানিদের দোসররা। এতে পাঁচজন নিহত হন। দিনের বেলা কারফিউ শিথিল করায় এদিনও বহু মানুষ ঢাকা ছাড়তে থাকে। কল্যাণপুর সেতুতে পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালিরা তল্লাশির নামে অনেক বাঙালিকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এদিন বিকেলে কুমিল্লা সেনানিবাসে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭০ থেকে ৮০ জন বাঙালি সেনা সদস্যের ওপর হামলা করে পাকিস্তানি সেনারা। বাঙালি সেনারা ছয়ঘণ্টা যুদ্ধ করে রেজিমেন্ট ইউনিট দখল করে।
৭১’র এদিন বিকালে কুষ্টিয়ায় কৃষক-পুলিশ-ইপিআরের সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি বাহিনীর ডেল্টা কোম্পানির সৈন্যদের পাঁচটি অবস্থানে হামলা করে। অগ্রসরমান জনসমুদ্র থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি এবং অব্যাহত গুলিতে ডেল্টা কোম্পানির প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আফতাব উদ্দিন খানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিকামী ছাত্রজনতা বর্তমান মাহমুদা চৌধুরী কলেজ রোডে পোস্ট অফিস সংলগ্ন মসজিদে শপথ নেন। ৩০ মার্চ শেষ রাতে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জিলা স্কুলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু কওে বাঙালী মুক্তিকামী মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনী নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে যশোর সেনানিবাসের সাহায্য চায়। কিন্তু সেখান থেকে কোনও সাহায্য না পাঠানোর সংকেত দিলে হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে তিনটি গাড়িতে করে গুলিবর্ষণ করতে করতে যশোর সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গাড়ি ঝিনাইদহ জেলার গাড়াগঞ্জের কাছে রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর ফাঁদে পড়ে যায়। সে সময় মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয় তারা। পাকিস্তানি বাহিনীর অপর ছয় জন সদস্য ভোরে জিলা স্কুল থেকে মিরপুরের দিকে পালিয়ে আসতে থাকে। প্রথম তারা উপজেলার বারুইপাড়া ইউপির মশান বাজার সংলগ্ন মাঠে তীব্র প্রতিরোধের মধ্যে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মশানের ডা. আব্দুর রশিদ হিলম্যান, গোলাপ শেখ, আশরাফ আলী ও সোনাউল্লাহ শহীদ হন। এদিন পাকিস্তানি হানাদারদের হামলায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ভেঙে যায়। এদিনে জেলার মিরপুর থানার কামারপাড়ায় বিচ্ছিন্ন তিন হানাদারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আবারও যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মিরপুর থানার সিপাহী মহিউদ্দিন শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনীর ওই তিন সদস্যও নিহত হয়। এভাবেই ধাপে ধাপে স্বাধীনতার সিঁড়ি বেয়ে অগ্রসর হতে থাকে মুক্তিকামী বাঙালী। ##

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

Dainik adhumati

জনপ্রিয়

কোস্টগার্ডের অভিযানে অস্ত্রসহ আটক -১ 

৩১ মার্চ ১৯৭১:

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে ভারতের সমর্থন

প্রকাশিত সময় : ০৯:২৭:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩

###     অগ্নিঝরা মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পাঁচ দিন পর। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি জানিয়ে আজকের দিনে ভারতের পার্লামেন্টের লোকসভা ও রাজ্যসভা একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এদিকে সারাদেশের মতো কুষ্টিয়ায় আফতাব উদ্দিন খানের বাহিনী স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ লোকসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তোলা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্মম হত্যাকা- বন্ধে পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করতে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ‘পূর্ব বাংলা সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব’ এ বলা হয়েছিল, “পূর্ব বাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের অভ্যুত্থান সফল হবে। এই পার্লামেন্ট আশা করে এবং নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে তাদের লড়াই ও ত্যাগ ভারতের জনগণের সর্বাত্মক সহানুভূতি ও সমর্থন পাবে।” এদিনে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে লক্ষাধিক শরণার্থী বিভিন্ন পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এদিন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সেখানকার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাদের সার্বিক সহায়তা করেন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার গার্ড অব অনার দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধির মর্যাদায় প্রদান করেন। আগের দিন কালুরঘাটে পাকিস্তান বাহিনীর বিমান হামলার পর এদিন চট্টগ্রাম থেকে এক কিলোওয়াট সম্পন্ন ট্রান্সমিটার প্রথমে পটিয়া নেওয়া হয়। পরে সীমান্ত পার করে ভারতের আগরতলায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার প্রচারণা চলতে থাকে। একাত্তর সালের ৩১ মার্চ চট্টগ্রামের হালিশহরে নাথপাড়ায় পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বিহারিরা এ হত্যাকা- চালায়। তারা অল্প সময়ের মধ্যে কুড়াল, কিরিচ ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে ৪০ জন ইপিআরসহ ৭৯ জনকে হত্যা করে। ঢাকার নারিন্দা মঠে হামলা চালায় পাকিস্তানিদের দোসররা। এতে পাঁচজন নিহত হন। দিনের বেলা কারফিউ শিথিল করায় এদিনও বহু মানুষ ঢাকা ছাড়তে থাকে। কল্যাণপুর সেতুতে পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালিরা তল্লাশির নামে অনেক বাঙালিকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এদিন বিকেলে কুমিল্লা সেনানিবাসে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭০ থেকে ৮০ জন বাঙালি সেনা সদস্যের ওপর হামলা করে পাকিস্তানি সেনারা। বাঙালি সেনারা ছয়ঘণ্টা যুদ্ধ করে রেজিমেন্ট ইউনিট দখল করে।
৭১’র এদিন বিকালে কুষ্টিয়ায় কৃষক-পুলিশ-ইপিআরের সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি বাহিনীর ডেল্টা কোম্পানির সৈন্যদের পাঁচটি অবস্থানে হামলা করে। অগ্রসরমান জনসমুদ্র থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি এবং অব্যাহত গুলিতে ডেল্টা কোম্পানির প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আফতাব উদ্দিন খানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিকামী ছাত্রজনতা বর্তমান মাহমুদা চৌধুরী কলেজ রোডে পোস্ট অফিস সংলগ্ন মসজিদে শপথ নেন। ৩০ মার্চ শেষ রাতে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জিলা স্কুলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু কওে বাঙালী মুক্তিকামী মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনী নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে যশোর সেনানিবাসের সাহায্য চায়। কিন্তু সেখান থেকে কোনও সাহায্য না পাঠানোর সংকেত দিলে হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে তিনটি গাড়িতে করে গুলিবর্ষণ করতে করতে যশোর সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গাড়ি ঝিনাইদহ জেলার গাড়াগঞ্জের কাছে রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর ফাঁদে পড়ে যায়। সে সময় মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয় তারা। পাকিস্তানি বাহিনীর অপর ছয় জন সদস্য ভোরে জিলা স্কুল থেকে মিরপুরের দিকে পালিয়ে আসতে থাকে। প্রথম তারা উপজেলার বারুইপাড়া ইউপির মশান বাজার সংলগ্ন মাঠে তীব্র প্রতিরোধের মধ্যে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মশানের ডা. আব্দুর রশিদ হিলম্যান, গোলাপ শেখ, আশরাফ আলী ও সোনাউল্লাহ শহীদ হন। এদিন পাকিস্তানি হানাদারদের হামলায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ভেঙে যায়। এদিনে জেলার মিরপুর থানার কামারপাড়ায় বিচ্ছিন্ন তিন হানাদারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আবারও যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মিরপুর থানার সিপাহী মহিউদ্দিন শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনীর ওই তিন সদস্যও নিহত হয়। এভাবেই ধাপে ধাপে স্বাধীনতার সিঁড়ি বেয়ে অগ্রসর হতে থাকে মুক্তিকামী বাঙালী। ##