০১:০০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আশ্বাসেই ২৭বছর পার : হয়নি সংস্কার ও গড়ে ওঠেনি পর্যটন কেন্দ্র

বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী পিসি রায়ের স্মৃতি নিশ্চিহ্নের পথে

  • সৌমি লাবন্য ।।
  • প্রকাশিত সময় : ১২:১০:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ অগাস্ট ২০২৩
  • ২০৮ পড়েছেন

####

বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী খ্যাত আচায্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ১৬৩তম জন্মবার্ষিক আজ ০২আগষ্ট। জগৎ বিখ্যাত এ বিজ্ঞানীর জন্মস্থান খুলনার পাইকগাছার রাড়ুলী গ্রামের বসতবাড়ী আজও চরম অবহেলায় রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের মন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আশ্বাসের পর আশ্বাসেও মোরমত হয়নি বিজ্ঞানী পি.সি রায়ের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীটি। গড়ে ওঠেনি বিজ্হান চর্চা এবং পিসি রায়ের জীবন ও গবেষনা নিয়ে জানার কোন সুযোগ। এমনকি পয্যটন বান্ধব কোন স্থাপনা গড়ে তোলারও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত ২৭বছর ধরে সরকারের মন্ত্রী, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অফিসার, সংসদ সদস্যসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে চরম ক্ষুব্ধ স্থানীয় এলাকাবাসী ও পিসি রায় প্রেমী বিজ্ঞান গবেষকরা। তবে বিশ্বখ্যাত এ বিজ্ঞানীর স্মৃতি ধরে রাখতে যথাযথ ‍উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন খুলনার জেলা প্রশাসক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী রসায়নবিদ আচায্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ওরফে পি,সি,রায় ১৮৬১ সালের ০২ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরের রাড়ুলী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা জমিদার হরিশ্চন্দ্র রায় ও মাতা ভূমন মোহিনী দেবী। পিতা তাকে আদর করে ডাকতেন ফুলু বলে। ফুলুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়স থেকে। ১৮৬৬ থেকে ১৮৭০ সাল চার বছর কাটে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ১৮৭১ সালে ভর্তি হন কলিকাতার হেয়ার স্কুলে। তারপর ১৮৭৪ অ্যালবার্ট স্কুলে। এখান থেকেই ১৮৭৮ সালে এন্টান্স ও ১৮৮১ সালে এফ,এ পাশ করেন তিনি। ১৮৮২ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি এবং অনার্সসহ স্নাতক শ্রেনীতে অসাধারন মেধার বলে তিনি গিলক্রিষ্ট বৃত্তি নিয়ে চলে যান এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই বিএসসি ডিগ্রি নেন। রসায়ন শাস্ত্রে গবেষনারত প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মারকুইরাস নাইট্রাইট-এর মত রসায়ন শাস্ত্রে মৌলিক পদার্থ উদ্ভাবন করার মাধ্যমে চমকে দেন বিশ্বকে। এরপর থেকে সম্মান সূচক ১৮৮৬ সালে পিএইচডি, ১৮৮৭ সালে ডিএসসি, ১৯১১ সালে সিআইই, ১৯১২ সালে আবার ডিএসসি, এবং ১৯১৮ সালে নাইট উপাধি পান। ১৯৪৪ সালে ১৬জুন কোন উত্তরসূরী না রেখে জীবনাবসান ঘটে বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের।

দেশ-বিদেশে বিরল সাধনার ক্ষেত্রে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ছাড়া এমনভাবে বাঙালী মানুষকে অন্য কেউ মহিমান্বিত করতে পারেনি। পি.সি রায় ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, দার্শনীক ও শিল্পী। সমাজ সংস্কারে মানবতাবোধে উজ্জীবিত ছিলেন তিনি। এলাকার চারটি গ্রামের নাম মিলে ১৯০৩ সালে বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় দক্ষিণ বাংলায় প্রথম আর,কে,বি,কে হরিশচন্দ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেন। তার পিতার নামে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। একই স্থানে স্যার পিসি রায়ের পিতা উপমহাদেশে নারী শিক্ষা উন্নয়নকল্পে ভূবন মোহিনীর নামে ১৮৫০ সালে রাড়ুলী গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তদানিন্তন সময়ে পল্লী মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায় ব্যাংক পদ্ধতি চালু করেন। ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমি রাড়ুলীতে কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো আজও স্বমহিমায় এগিয়ে চলছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পি.সি রায় বিজ্ঞান সাধনার ফলাফলের সফল প্রয়োগ ঘটান। লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের বেনারশ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় তাকে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। তিনি বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করে বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী হিসেবে অবিহিত হন। রসায়ন নিয়ে তিনি নতুন অনেক কিছুই উদ্ভাবন করেই তিনি ধ্রুবতারা।

পি.সি রায় একাধারে প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, বিজ্ঞান শিক্ষক, দার্শনিক ও কবি। তিনি বেঙ্গল কেমিকালের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কিউরাস নাইট্রাইট-এর আবিষ্কারক ও দেশীয় শিল্পায়ন উদ্যোক্তা। তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট এসিড আবিস্কার করে বিশ্বে আড়োলন সৃষ্টি করেন ১৮৯৫ সালে। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট উপাধি এবং ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে নাইট উপাধি দেয়। তিনি বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসুর সহকর্মী ছিলেন। বিজ্ঞানী জগদিশ চন্দ্র বসু তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন একজন পথিকৃত ও মহান সৃষ্টির স্রষ্টা এই দুই ভূমিকাতেই পি.সি রায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেন। গোড়া থেকেই তিনি উচ্চ মানের মৌলিক অনুসন্ধান কাজের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরণের পারদর্শীতা দেখিয়েছেন।

প্রথিতযশা বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এক প্রবন্ধে আচায্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সম্পর্কে উল্লেখ করেন রাসায়নিক গবেষণায় তিনি একজন প্রধান পথিকৃত। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারই কাছ থেকে শিক্ষাদিক্ষা পেয়ে বহু ভারতীয় নানা ক্ষেত্রে যশ অর্জন করেছে। ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্মরণীকায় উল্লেখ করা হয়েছে পিসি রায়ের সততা, সরলতা ও প্রভাব বিস্তারকারী ক্ষমতা তার চরিত্রের  বৈশিষ্ট্য। তার অদম্য সাহস ও দেশ প্রেম এক অনন্য। শিল্প বিকাশে তিনি অগ্রনায়ক। তার অনন্য সৃষ্টি মারকিউরাস নাইট্রেইট সফল বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি মেলে। তিনি ত্যাগী মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য দিয়েছেন এবং বিলিয়েছেন। তার সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু মানুষকে নিয়ে।

দেশ-বিদেশে পি.সি রায়ের প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আজও মানব সেবা দিচ্ছে। অথচ ফাদার নাইট্রাইট খ্যাত বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার পি,সি রায়ের জন্ম ভিটা বাড়ীর ভবনগুলো আজও অবহেলিত। ধসে ধসে পড়ছে ভবনের বিভিন্ন অংশ। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় বিভিন্ন ভাবে অপচেষ্টা চলে পি,সি রায়ের জন্মভূমি স্মৃতি চিহ্ন বসতভিটা দখলের।সবশেষ ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে স্মৃতিচিহ্ন বসতভিটা দখল নেয় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। এতে ফুসে ওঠে পি,সি,রায় প্রেমী এলাকার সচেতন মানুষসহ প্রসাসনের কর্মকর্তারা। কঠোর আন্দোলনের মুখে সে সময় রাতের অন্ধকারে বাড়ীর মূল্যবান সম্পদ নিয়ে পালিয়ে যায় কথিত দখলদাররা।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর পদচারনা ও নিজ হাতের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আজও অবহেলিত রয়েছে। ফাদার অব নাইট্রাইট খ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায়ের জন্মস্থান রাড়ুলী গ্রামটিও অবহেলিত। ১৯৯৬ সাল থেকে পিসি রায়ের জন্ম ভিটাবাড়ি সরকারের প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণ করছে। সরকারী উদ্যোগে পালিত হয়ে আসছে তার জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী। প্রতি বছর রাড়ুলীতেপিসি রায়েল  জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি মেরামত, সংস্কার ও পয্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোরার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৯৬সাল থেকে আজও তার বিন্দু মাত্রও বাস্তবায়ন হয়নি। দিন দিন ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে এ বিজ্ঞানীর জন্মভিটা। এ নিয়ে চরম ক্ষব্ধ এলাবাসী।

পিসি রায় স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির অন্যতম সদস্য শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ জানান, বিশ্ববরেণ্য এ বিজ্ঞানীর বসত বাড়িকে কেন্দ্র করে পয্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পি.সি রায় প্রেমী জগৎ বিখ্যাত এ বিজ্ঞানীর জীবনী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারবে। বিশ্ব বরেণ্য এ বিজ্ঞানীর বসতবাড়ী সংরক্ষণসহ পয্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে সরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করার সরকারী প্রতিশ্রুতি দ্রুতই বাস্তবয়ন হোক এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।

খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা এ প্রতিবেদককে জানান, ১৯৯৬ সালের ৯ নভেম্বর রাড়ুলীর রায় চৌধুরী পরিবারের এই বাড়িটি পুরাকৃর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই বাড়ির ৫একর ১৪ শতক জমির মধ্যে ৪একর নিয়ে মামলা চলছিল। আমেনা বেগম নামে এক স্বার্থান্বেষী মালিকানা দাবি করে মামলা করলে জমিটি খাস খতিয়ানের উল্লেখ করে হাইকোর্ট বাদির মামলা খারিজ করেছে। ২০১৪ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১ দশমিক ১৪ শতক জমির অধিগ্রহণ করে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে। এখানে পয্যটন বান্ধব পরিবেশ, ভবন সংস্কার, ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে পয্যটকদের জন্য দৃষ্টি নন্দন করা হবে। বিজ্ঞানীর বাস ভবনটির দৃষ্টিনন্দন হলে এখানে পয্যটকের সংখ্যা বাড়বে। তার অবদান সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম অবহিত হতে পারবে।

খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন এ প্রতিবেদককে জানান, পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলীতে বিজ্ঞানী পিসি রায়ের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি দৃষ্টি নন্দন করার জন্য জেলা প্রশাসন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প প্রেরণ করেছে। বাড়ীর জমির মালিকানা দাবি করে স্বার্থান্বেষী মহলের দায়ের করা মামলা উচ্চ আদালত খারিজ হয়েছে। রাড়ুলীর রায় চৌধুরী পরিবারের ৫একর জমির ওপর জাদুঘর, গবেষণাগার ও পয্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর অমর কৃর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং তার কর্মময় জীবন ও গবেষণার বিষয়ে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং বিজ্ঞান চর্চাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিজ্ঞানী পিসি রায় রসায়ন শাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। খুলনার ক্ষণজন্মা এই কৃতি সন্তান বিজ্ঞানী শিক্ষানুরাগী ও সমাজ সেবক। তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য দৃষ্টি নন্দন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বুধবার (০২আগষ্ট) বিজ্ঞানী পিসি রায়ের ১৬৩তম জন্ম বার্ষিকীতে তার স্মৃতি বিজড়িত রাড়ুলীর বসত ভিটায় সরকারীভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলী প্রদান, আলোচনাসভাসহ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন কুমার ভট্টাচায্য। অনুষ্ঠানে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। ##

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

Dainik Madhumati

জনপ্রিয়

সাতক্ষীরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মতবিনিময় সভা দু’গ্রুপের হাতাহাতিতে ভন্ডুল

আশ্বাসেই ২৭বছর পার : হয়নি সংস্কার ও গড়ে ওঠেনি পর্যটন কেন্দ্র

বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী পিসি রায়ের স্মৃতি নিশ্চিহ্নের পথে

প্রকাশিত সময় : ১২:১০:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ অগাস্ট ২০২৩

####

বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী খ্যাত আচায্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ১৬৩তম জন্মবার্ষিক আজ ০২আগষ্ট। জগৎ বিখ্যাত এ বিজ্ঞানীর জন্মস্থান খুলনার পাইকগাছার রাড়ুলী গ্রামের বসতবাড়ী আজও চরম অবহেলায় রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের মন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আশ্বাসের পর আশ্বাসেও মোরমত হয়নি বিজ্ঞানী পি.সি রায়ের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীটি। গড়ে ওঠেনি বিজ্হান চর্চা এবং পিসি রায়ের জীবন ও গবেষনা নিয়ে জানার কোন সুযোগ। এমনকি পয্যটন বান্ধব কোন স্থাপনা গড়ে তোলারও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত ২৭বছর ধরে সরকারের মন্ত্রী, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অফিসার, সংসদ সদস্যসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে চরম ক্ষুব্ধ স্থানীয় এলাকাবাসী ও পিসি রায় প্রেমী বিজ্ঞান গবেষকরা। তবে বিশ্বখ্যাত এ বিজ্ঞানীর স্মৃতি ধরে রাখতে যথাযথ ‍উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন খুলনার জেলা প্রশাসক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী রসায়নবিদ আচায্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ওরফে পি,সি,রায় ১৮৬১ সালের ০২ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরের রাড়ুলী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা জমিদার হরিশ্চন্দ্র রায় ও মাতা ভূমন মোহিনী দেবী। পিতা তাকে আদর করে ডাকতেন ফুলু বলে। ফুলুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়স থেকে। ১৮৬৬ থেকে ১৮৭০ সাল চার বছর কাটে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ১৮৭১ সালে ভর্তি হন কলিকাতার হেয়ার স্কুলে। তারপর ১৮৭৪ অ্যালবার্ট স্কুলে। এখান থেকেই ১৮৭৮ সালে এন্টান্স ও ১৮৮১ সালে এফ,এ পাশ করেন তিনি। ১৮৮২ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি এবং অনার্সসহ স্নাতক শ্রেনীতে অসাধারন মেধার বলে তিনি গিলক্রিষ্ট বৃত্তি নিয়ে চলে যান এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই বিএসসি ডিগ্রি নেন। রসায়ন শাস্ত্রে গবেষনারত প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মারকুইরাস নাইট্রাইট-এর মত রসায়ন শাস্ত্রে মৌলিক পদার্থ উদ্ভাবন করার মাধ্যমে চমকে দেন বিশ্বকে। এরপর থেকে সম্মান সূচক ১৮৮৬ সালে পিএইচডি, ১৮৮৭ সালে ডিএসসি, ১৯১১ সালে সিআইই, ১৯১২ সালে আবার ডিএসসি, এবং ১৯১৮ সালে নাইট উপাধি পান। ১৯৪৪ সালে ১৬জুন কোন উত্তরসূরী না রেখে জীবনাবসান ঘটে বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের।

দেশ-বিদেশে বিরল সাধনার ক্ষেত্রে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ছাড়া এমনভাবে বাঙালী মানুষকে অন্য কেউ মহিমান্বিত করতে পারেনি। পি.সি রায় ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, দার্শনীক ও শিল্পী। সমাজ সংস্কারে মানবতাবোধে উজ্জীবিত ছিলেন তিনি। এলাকার চারটি গ্রামের নাম মিলে ১৯০৩ সালে বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় দক্ষিণ বাংলায় প্রথম আর,কে,বি,কে হরিশচন্দ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেন। তার পিতার নামে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। একই স্থানে স্যার পিসি রায়ের পিতা উপমহাদেশে নারী শিক্ষা উন্নয়নকল্পে ভূবন মোহিনীর নামে ১৮৫০ সালে রাড়ুলী গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তদানিন্তন সময়ে পল্লী মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায় ব্যাংক পদ্ধতি চালু করেন। ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমি রাড়ুলীতে কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো আজও স্বমহিমায় এগিয়ে চলছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পি.সি রায় বিজ্ঞান সাধনার ফলাফলের সফল প্রয়োগ ঘটান। লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের বেনারশ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় তাকে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। তিনি বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করে বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী হিসেবে অবিহিত হন। রসায়ন নিয়ে তিনি নতুন অনেক কিছুই উদ্ভাবন করেই তিনি ধ্রুবতারা।

পি.সি রায় একাধারে প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, বিজ্ঞান শিক্ষক, দার্শনিক ও কবি। তিনি বেঙ্গল কেমিকালের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কিউরাস নাইট্রাইট-এর আবিষ্কারক ও দেশীয় শিল্পায়ন উদ্যোক্তা। তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট এসিড আবিস্কার করে বিশ্বে আড়োলন সৃষ্টি করেন ১৮৯৫ সালে। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট উপাধি এবং ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে নাইট উপাধি দেয়। তিনি বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসুর সহকর্মী ছিলেন। বিজ্ঞানী জগদিশ চন্দ্র বসু তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন একজন পথিকৃত ও মহান সৃষ্টির স্রষ্টা এই দুই ভূমিকাতেই পি.সি রায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেন। গোড়া থেকেই তিনি উচ্চ মানের মৌলিক অনুসন্ধান কাজের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরণের পারদর্শীতা দেখিয়েছেন।

প্রথিতযশা বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এক প্রবন্ধে আচায্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সম্পর্কে উল্লেখ করেন রাসায়নিক গবেষণায় তিনি একজন প্রধান পথিকৃত। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারই কাছ থেকে শিক্ষাদিক্ষা পেয়ে বহু ভারতীয় নানা ক্ষেত্রে যশ অর্জন করেছে। ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্মরণীকায় উল্লেখ করা হয়েছে পিসি রায়ের সততা, সরলতা ও প্রভাব বিস্তারকারী ক্ষমতা তার চরিত্রের  বৈশিষ্ট্য। তার অদম্য সাহস ও দেশ প্রেম এক অনন্য। শিল্প বিকাশে তিনি অগ্রনায়ক। তার অনন্য সৃষ্টি মারকিউরাস নাইট্রেইট সফল বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি মেলে। তিনি ত্যাগী মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য দিয়েছেন এবং বিলিয়েছেন। তার সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু মানুষকে নিয়ে।

দেশ-বিদেশে পি.সি রায়ের প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আজও মানব সেবা দিচ্ছে। অথচ ফাদার নাইট্রাইট খ্যাত বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার পি,সি রায়ের জন্ম ভিটা বাড়ীর ভবনগুলো আজও অবহেলিত। ধসে ধসে পড়ছে ভবনের বিভিন্ন অংশ। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় বিভিন্ন ভাবে অপচেষ্টা চলে পি,সি রায়ের জন্মভূমি স্মৃতি চিহ্ন বসতভিটা দখলের।সবশেষ ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে স্মৃতিচিহ্ন বসতভিটা দখল নেয় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। এতে ফুসে ওঠে পি,সি,রায় প্রেমী এলাকার সচেতন মানুষসহ প্রসাসনের কর্মকর্তারা। কঠোর আন্দোলনের মুখে সে সময় রাতের অন্ধকারে বাড়ীর মূল্যবান সম্পদ নিয়ে পালিয়ে যায় কথিত দখলদাররা।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর পদচারনা ও নিজ হাতের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আজও অবহেলিত রয়েছে। ফাদার অব নাইট্রাইট খ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায়ের জন্মস্থান রাড়ুলী গ্রামটিও অবহেলিত। ১৯৯৬ সাল থেকে পিসি রায়ের জন্ম ভিটাবাড়ি সরকারের প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণ করছে। সরকারী উদ্যোগে পালিত হয়ে আসছে তার জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী। প্রতি বছর রাড়ুলীতেপিসি রায়েল  জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি মেরামত, সংস্কার ও পয্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোরার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৯৬সাল থেকে আজও তার বিন্দু মাত্রও বাস্তবায়ন হয়নি। দিন দিন ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে এ বিজ্ঞানীর জন্মভিটা। এ নিয়ে চরম ক্ষব্ধ এলাবাসী।

পিসি রায় স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির অন্যতম সদস্য শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ জানান, বিশ্ববরেণ্য এ বিজ্ঞানীর বসত বাড়িকে কেন্দ্র করে পয্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পি.সি রায় প্রেমী জগৎ বিখ্যাত এ বিজ্ঞানীর জীবনী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারবে। বিশ্ব বরেণ্য এ বিজ্ঞানীর বসতবাড়ী সংরক্ষণসহ পয্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে সরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করার সরকারী প্রতিশ্রুতি দ্রুতই বাস্তবয়ন হোক এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।

খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা এ প্রতিবেদককে জানান, ১৯৯৬ সালের ৯ নভেম্বর রাড়ুলীর রায় চৌধুরী পরিবারের এই বাড়িটি পুরাকৃর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই বাড়ির ৫একর ১৪ শতক জমির মধ্যে ৪একর নিয়ে মামলা চলছিল। আমেনা বেগম নামে এক স্বার্থান্বেষী মালিকানা দাবি করে মামলা করলে জমিটি খাস খতিয়ানের উল্লেখ করে হাইকোর্ট বাদির মামলা খারিজ করেছে। ২০১৪ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১ দশমিক ১৪ শতক জমির অধিগ্রহণ করে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে। এখানে পয্যটন বান্ধব পরিবেশ, ভবন সংস্কার, ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে পয্যটকদের জন্য দৃষ্টি নন্দন করা হবে। বিজ্ঞানীর বাস ভবনটির দৃষ্টিনন্দন হলে এখানে পয্যটকের সংখ্যা বাড়বে। তার অবদান সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম অবহিত হতে পারবে।

খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন এ প্রতিবেদককে জানান, পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলীতে বিজ্ঞানী পিসি রায়ের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি দৃষ্টি নন্দন করার জন্য জেলা প্রশাসন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প প্রেরণ করেছে। বাড়ীর জমির মালিকানা দাবি করে স্বার্থান্বেষী মহলের দায়ের করা মামলা উচ্চ আদালত খারিজ হয়েছে। রাড়ুলীর রায় চৌধুরী পরিবারের ৫একর জমির ওপর জাদুঘর, গবেষণাগার ও পয্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর অমর কৃর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং তার কর্মময় জীবন ও গবেষণার বিষয়ে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং বিজ্ঞান চর্চাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিজ্ঞানী পিসি রায় রসায়ন শাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। খুলনার ক্ষণজন্মা এই কৃতি সন্তান বিজ্ঞানী শিক্ষানুরাগী ও সমাজ সেবক। তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য দৃষ্টি নন্দন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বুধবার (০২আগষ্ট) বিজ্ঞানী পিসি রায়ের ১৬৩তম জন্ম বার্ষিকীতে তার স্মৃতি বিজড়িত রাড়ুলীর বসত ভিটায় সরকারীভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলী প্রদান, আলোচনাসভাসহ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন কুমার ভট্টাচায্য। অনুষ্ঠানে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। ##