####
সুনীল দাস :
মাত্র ১৪বছর বয়সে অদম্য মেধাবী ৯ম শ্রেনীর ছাত্র রাকিব ভুইয়া অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেরই উপার্জিত অর্থ দিয়ে রোবট বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এজন্য তাকে কখনও চালাতে হয়েছে ভ্যান, কখনো ফেরি করে বিক্রি করতে হয়েছে মুরগি। তবুও থেমে যায়নি সে। তার তৈরী রোবটের কাছাকাছি কেউ আসলে হ্যান্ডশেক করে, কথাও বলে। জবাব দেয় সালামের। দেশের রাজধানী ও রাষ্ট্রপতির নামসহ হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেয় নির্ভুলভাবে। কখনও শোনায় গান। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পারে চারপাশ। আগুন লাগলে দিতে পারে সংকেত কিংবা শত্রুর প্রতি চালাতে পারে গুলিও। গত পাঁচ বছরের সঞ্চয় ও ৬মাসের প্রচেষ্টায় এমন বুদ্ধিদীপ্ত রোবট তৈরীতে সে সফলতা পেয়েছে। তার তৈরী রোবট দেখে বিস্মিত ও গর্বিত স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রতিবেশীরা। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছেন রাকিবের রোবট দেখতে।
জানা গেছে, খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়নের বরনপাড়া গ্রামের কামরুল ভূইয়ার ছেলে রাকিব ভূইয়া। সে উপজেলার দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনীর ছাত্র। প্রত্যন্ত গ্রামে সরকারি প্রকল্পের টিনের ছোট্ট ঘরে থাকে বাবা-মা আর বোনকে নিয়ে বসবাস রাকিবের। বাবা পেশায় ভ্যানচালক এবং মা হাসি বেগম গৃহিণী। পরিবারের চরম দারিদ্রতার মাঝেই রাকিবের বেড়ে ওঠা। দারিদ্রতার মাঝেও ছেলের উদ্ভাবনী ইচ্ছাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন তারা। অভাবের সংসারের কারণে কখনও ভ্যান চালিয়েছে, কখনও মুরগী ফেরি করে বিক্রি করেছে। তারপরও লেখাপড়া ও রোবট তৈরীর উৎসাহে ভাটা পড়েনি অদম্য কিশোর রাকিবের।
শুক্রবার রাকিবের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়, গাছপারা ঘেরা সরকারি প্রকল্পের টিনের ছোট্ট ঘরে তাদের বসবাস। সেখানে কোন রকমে মাথা গোজার ঠাই হলেও নেই সুষ্ঠু লেখাপড়ার পরিবেশ। চোট্ট একটা টিনের ঘরে রাকিবের থাকা, ও লেখাপড়াসহ রোবট তৈরীর সকল কিছুই। ঘরের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে রোবট তৈরীল সরঞ্জাম ও স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় পাওয়া উপহার। এখন তার সবকিছুই ঘিরে রয়েছে রোবট।
নবম শ্রেনীর ছাত্র রাকিব জানায়, সংসারের অভাব-অনটনের কারনে মা-বাবার প্রত্যাশা ছিল লেখাপড়া করে চাকুরী করে পরিবারের উন্নয়ন করা। কিন্তু লেখাপড়ার জন্য যে সহায়তা সেটাও জোগাড় করাই ছিল দু:সাধ্য। ভ্যান চালক পিতাকে সহায়তা করতে চালিয়েছেন ভ্যান। মাঝে মধ্যে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে মুরগী কিনে সেটি ফেরী করে বিক্রি করেও চলেছে তাদের সংসার। গত বছর পাচেক আগে ৫ম শ্রেনীতে পড়াকালীন স্কুলের হয়ে উপজেলায় বিজ্ঞান মেলায় অংশ নেয় সে। সেখানে পুরষ্কারও পায় রাকিব। এরপর তার মনে আরও ভালো কিছু করার বাসনা তৈরী হয়। সেখান থেকে তার মনে জাগে এমন কিছু করতে যার দ্বারা পরিবারের ও সমাজের উপকার হয়। সেই ভাবনা থেকেই রোবট তৈরীতে মনোযোগী হয় সে। কিন্তু টাকা কোথায় পাবে এ ভাবনায় শুরু হয় ভ্যান চালিয়ে ও মুরগী ফেরী করে বিক্রি থেকে টাকা সঞ্চয় করা। গত পাচ বছরে সঞ্চিত টাকা দিয়ে সে গুগল থেকে প্রক্রিয়া রপ্ত করে রোবটের বিভিন্ন উপকরণ কেনে। ইতিমধ্যেই সে একটি মিনি কম্পিউটার তৈরী করে সেটাও বিক্রি করে বেশকিছু টাকা জোগাড় হয় তার। পরে স্কুলের পড়াশোনা ও পরিবারের কাজের পাশাপাশি সোসাল মিডিয়ার সহায়তা নিয়ে ছয় মাসের বেশি সময় পরিশ্রম করে ‘গুগল অনিক্স’ নামে রোবট তৈরি করেছে রাকিব। এজন্য তার খরচ হয়েছে ৩০-৩৫হাজার টাকা। নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে ছয় মাসের চেষ্টায় স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে রাকিবের।
সে আরও জানায়, তার তৈরি রোবট কথা বলতে পারে, হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেয় নির্ভুলভাবে। জবাব দেয় সালামের, শোনায় ছড়া-কবিতা ও গানও। চারপাশটা দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে। গ্যাস লিকেজ ও আগুন জ্বললে দেয় সিগন্যাল। একইসঙ্গে কল দেয় মালিকের ফোনে। ফোন কল রিসিভ না হলে সহায়তার জন্য সে নিজেই ৯৯৯-এ কল দিতেও পারে। চাকার সাহায্যে ছুটতে পারে এদিক-সেদিক। ভেতরে সেট করা প্রোগ্রামের মাধ্যমে সব প্রশ্নের জবাব দেয় রোবটটি। এমনকি জটিল কোন প্রশ্ন হলে রোবটটি গুগল, চ্যাট জিপিটি, এআই বা ওয়েবসাইট থেকে সব ধরনের আপডেট জবাব দিতে পারে।
রাকিব ভূইয়া আরও জানায়, তার তৈরি করা রোবট ধ্বংসাত্মক কাজ দেখলেই সিগন্যাল পাঠানো ও আত্মরক্ষা করতেও সক্ষম। এ ছাড়া সিকিউরিটি গার্ড, আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য প্রদান, আগুনের মধ্যে মানুষ শনাক্ত করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সহায়তা করতে পারবে এই রোবট।
রাকিব জানায়, মানুষের কল্যানে কিছু একটা তৈরির ইচ্ছা ও স্বপ্ন থেকেই রোবট তৈরি করা শুরু করি। যখন রোবট তৈরীর কাজ শুরু করি তখন সহপাঠি ও এলাকার মানুষ অনেকেই পাগল বলেছে। কিন্তু এখন সবাই ভারো বলছে ও প্রশংসা করছে। এটা পরিপূর্ণ একটি রোবট। যদি আরও ভালোভাবে করা হয় তাহলে রোবটটি আধুনিক করা সম্ভব হবে। এটি মানুষের সেবায় কাজে লাগবে। রোবটটি ছেড়ে দিলে অটোমেটিক সে মানুষ শনাক্ত করতে পারবে এবং আমাদের কাছে লোকেশন পাঠাবে। সেই লোকেশন অনুযায়ী লোকটাকে শনাক্ত করে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়াও নানাবিধ কাজে এই রোবট ব্যবহার করা যাবে। আরও আপডেট মডেলের রোবট তৈরি ও ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে রোবট তৈরী করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। তার রোবট তৈরির খবরে দূরদূরান্ত থেকে ভিড় করছে উৎসুক মানুষ।
অনটনের সংসারে ছেলে রোবট তৈরী করায় আনন্দিত রাকিবের পিতা-মাতাসহ পরিবার। রাকিবের মা হাসি বেগম বলেন, রাকিব অনেক কষ্ট করে রোবটটি তৈরি করেছে। ভ্যান চালিয়ে, ফেরি করে। আমরা তেমন সহযোগিতা করতে পারিনি। তবুও সে এটি বানিয়েছে। খুব ভালো লাগছে। এখন সরকারের সহযোগিতা পেলে রাকিব আরও ভালো কিছু করতে পারবে। রাকিবের মেধা কাজে লাগাতে সরকারি-বেসরকারিভাবে তাকে আর্থিক-কারিগরি সহায়তা দেয়ার আবেদন জানান তিনি।
রাকিবের প্রতিবেশী খুলনা বিএল কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকলেও রাকিব ইন্টারনেটের সহযোগিতায় রোবট তৈরি করেছে। এটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও উৎফুল্লদায়ক। তার আবিস্কারে আমরা র্গবিত। রাকিব এই বিষয়ে যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায় তাহলে তার আরও উন্নতি হবে। দেশের কল্যাণে কাজে আসবে। দেশের সম্পদ হিসেবে কাজ করবে। এ জন্য সরকারের সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতার দাবী করেন তিনি।
রাকিবের স্কুলের সহপাঠি রাতুল হাসান ও ইমন হোসেন জানায়, রাকিবকে প্রথম দিকে পাগলের মত কি করছে বলেও ক্ষেপিয়েছে। কিন্তু অনেক কষ্ট করে রোবট তৈরীর পর সবাই স্কুলের ও আমাদের সুনাম করছে। আমাদের স্কুলের জন্য রাকিব এখনর্ র্গবের। তার দেখাদেখি আমরাও এমন একটা কিছু করতে চায়। আমরাও উৎসাহিত হয়েছি।
সু
রাকিবের বিদ্যালয় দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক এসএম. আব্দুল হালিম বলেন, রাকিবের সৃজনীমূলক কাজের জন্য তার স্কুল দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা, ক্রেস্ট ও আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে। একই সাথে রাকিবকে বিনা বেতনে স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সে এখন আমাদের গর্বের বিষয়। হত দরিদ্র পরিবারের ছেরে রাকিবের মেধার সঠিক বিকাশে ও উন্নয়নে সরকারসহ বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।
ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাসনীম জাহান বলেন, স্কুলছাত্র রাকিব নিজ প্রচেষ্টায় রোবটটি তৈরি করেছে জেনে আমরা খুবই খুশী। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি, তার বাড়িতে সরেজমিনে গিয়েছি। তার এই রোবট তৈরিতে কীভাবে আরও সহযোগিতা করা যায় সেই বিষয়টি জেলা প্রশাসন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে সহায়তার চেষ্টা করা হবে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তার সার্বিক সহযোগিতায় কাজ করার আশ্বাস দেন তিনি। ##
অফিস : ৬৯/৭০ কেসিসি সুপার মার্কেট ( ২য় তলা ) খুলনা সদর, খুলনা। প্রকাশক - সম্পাদক : সুনীল দাস বার্তা সম্পাদক : তরিকুল ইসলাম ডালিম চিফ রিপোর্টার : মোঃ নাঈমুজ্জামান শরীফ । যোগাযোগ : dainikmadhumati@gmail.com, newsdainikmadhumoti@gmail.com Office No : Editor : 01712680702 / 01912067948
© All rights reserved by www.dainikmadhumati.com (Established in 2022)