০৫:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধ ও শাহজাহান মাস্টার (পর্ব- ২)

####

সময়টা তখন ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ঢাকায় তখন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ১ মার্চে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছে শোনার পর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু হয়। তবে শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ২রা মার্চে এর আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়। যার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ২রা মার্চে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয়। পরে আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর আহবানে যখন দেশজুড়ে অসহযোগ ও পশ্চিমাদের প্রতি প্রবল ঘৃণা বিস্তার লাভ করছিল তখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুর গ্রামের মধ্যে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ২৫ এর কাল রাত্রে হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ২৬ তারিখে যখন শাহজাহান মাস্টার জানতে পারেন তখন তার মনের মধ্যে জমে থাকা পুরাতন দিনের পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রাগ ক্ষোভ সব একটি সংহতি রূপ নেয়।
১৯৬৪ সালে তৎকালীন সৃষ্ট মুজাহিদে শাহজান মাস্টার যোগদান করেন। হাই স্কুলের হেডমাস্টার থাকাকালীন মুজাহিদে এই যোগদানে তিনি “ছালারে আওয়াল” অর্থাৎ ক্যাপ্টেন পদটা পেয়ে যান। এরপর ট্রেনিং নেন। ৬৫ – ৬৬ সালে পাক ভারত যুদ্ধ উপলক্ষে এলাকার বহু মুজাহিদের নেতা হিসেবে সাতক্ষীরা এবং যশোরের পাক সেনাদের সাথে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে পাকিস্তানিদের, বাঙ্গালীদের প্রতি যে বৈষম্য, ঘৃণা ও অপমানকর আচরণ তার মনের মধ্যে পশ্চিমাদের প্রতি প্রবল ঘৃণা ও ক্ষোভের জন্ম নেয়।
তিনি চিন্তা করতে থাকেন কিছু একটা করার জন্য। ২৭শে মার্চ তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার টাকি হাসনাবাদ, বসিরহাট কলকাতার পিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। এ সময় ভারতের ঐ সকল এলাকা থেকে টাউন শ্রীপুর শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সহযোগিতা করার জন্য যাতায়াত এবং সলা পরামর্শ করতে থাকেন। এ সময়ে আগামী দিনে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রাথমিকভাবে কি কি দরকার সে সকল প্রয়োজনীয়তা জানতে চান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন লোকজন সাহায্য সামগ্রী নিয়ে টাউন শ্রীপুর শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় আসতে থাকেন। এমনি এক সময়ে সাতক্ষীরা থেকে এ এফ এম এনতাজ আলী, পারুলিয়া থেকে আতিয়ার রহমান সাহেব শাহজাহান মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করেন। মার্চ মাসের ২৮ তারিখে গোপনে দেবহাটা হাই স্কুলে (বিবিএমপি ইনস্টিটিউশন) তৎকালীন দেবহাটা থানার ওসি হারিস উদ্দিন এর সহযোগিতায় সাতক্ষীরা ও পারুলিয়া থেকে আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের অত্র এলাকার নেতৃবৃন্দ কে নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। শাহাজাহান মাস্টার এর সভাপতিত্বে এই সভায় সর্ব সিদ্ধান্তক্রমে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এই সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হিসেবে শাহজাহান মাস্টারকে সভাপতি এবং বাবু সনৎ কুমার সেনগুপ্ত (সন্তু বাবু) কে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। পরদিন বসিরহাট টাউন হাই স্কুলের দোতালায় শাহজাহান মাস্টার, সন্তু বাবু সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এক সভা হয়। এই সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শাহজাহন মাস্টার
এবং পারুলিয়ার দেলদার আহমেদ সরদার বক্তব্য রাখেন। এ সময় যশোর ক্যান্টনমেন্টের চারপাশে তখন জোর লড়াই চলছে। পিপিআর সদস্যরা তখন বর্ডার আউটপোস্ট থেকে যশোরের দিকে চলে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় শাহজাহান মাস্টার এর নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক দেবহাটা ইপিআর ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এই অভিযানে পারুলিয়ার আতিয়ার রহমান গদাই অদম্য সাহসিকতার সাথে ক্যাম্পে ডিউটিতে থাকা পাকিস্তানি ই পি আর সদস্যকে জাপটে ধরে হাতিয়ার কেড়ে নেয় এবং অন্যান্যরা এই সুযোগে ক্যাম্পের মধ্যে প্রবেশ করে সবাইকে বন্দি করে। ক্যাম্পের মধ্যে পাঁচ জন পাকিস্তানি ই পি আর সদস্য ছিল। তাদেরকে ধরি আনার পরে নৌকায় করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। এই দিনেই দোপাট্টা থানার তৎকালীন ওসি হারেজ উদ্দিন থানা রক্ষিত হাতিয়ারগুলি হাওজান মাস্টারদের হাতে তুলে দেন। শুরু হলো এলাকার শিক্ষিত – অশিক্ষিত যুবকদের নিয়ে টাউন শ্রীপুর হাই স্কুলে মুজাহিদদের দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং দেওয়া। শুরু হল স্বাধীনতা সংগ্রাম / মুক্তিযুদ্ধের পথে পথ চলা।
তথ্য : ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের ডায়েরি থেকে নেয়া।

Tag :
লেখক তথ্য সম্পর্কে

Dainik Madhumati

জনপ্রিয়

গোপালগঞ্জে অপচিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, কথিত ডাক্তার আটক

সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধ ও শাহজাহান মাস্টার (পর্ব- ২)

প্রকাশিত সময় : ১১:১৭:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ জুলাই ২০২৪

####

সময়টা তখন ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ঢাকায় তখন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ১ মার্চে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছে শোনার পর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু হয়। তবে শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ২রা মার্চে এর আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়। যার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ২রা মার্চে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয়। পরে আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর আহবানে যখন দেশজুড়ে অসহযোগ ও পশ্চিমাদের প্রতি প্রবল ঘৃণা বিস্তার লাভ করছিল তখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুর গ্রামের মধ্যে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ২৫ এর কাল রাত্রে হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ২৬ তারিখে যখন শাহজাহান মাস্টার জানতে পারেন তখন তার মনের মধ্যে জমে থাকা পুরাতন দিনের পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রাগ ক্ষোভ সব একটি সংহতি রূপ নেয়।
১৯৬৪ সালে তৎকালীন সৃষ্ট মুজাহিদে শাহজান মাস্টার যোগদান করেন। হাই স্কুলের হেডমাস্টার থাকাকালীন মুজাহিদে এই যোগদানে তিনি “ছালারে আওয়াল” অর্থাৎ ক্যাপ্টেন পদটা পেয়ে যান। এরপর ট্রেনিং নেন। ৬৫ – ৬৬ সালে পাক ভারত যুদ্ধ উপলক্ষে এলাকার বহু মুজাহিদের নেতা হিসেবে সাতক্ষীরা এবং যশোরের পাক সেনাদের সাথে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে পাকিস্তানিদের, বাঙ্গালীদের প্রতি যে বৈষম্য, ঘৃণা ও অপমানকর আচরণ তার মনের মধ্যে পশ্চিমাদের প্রতি প্রবল ঘৃণা ও ক্ষোভের জন্ম নেয়।
তিনি চিন্তা করতে থাকেন কিছু একটা করার জন্য। ২৭শে মার্চ তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার টাকি হাসনাবাদ, বসিরহাট কলকাতার পিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। এ সময় ভারতের ঐ সকল এলাকা থেকে টাউন শ্রীপুর শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সহযোগিতা করার জন্য যাতায়াত এবং সলা পরামর্শ করতে থাকেন। এ সময়ে আগামী দিনে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রাথমিকভাবে কি কি দরকার সে সকল প্রয়োজনীয়তা জানতে চান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন লোকজন সাহায্য সামগ্রী নিয়ে টাউন শ্রীপুর শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় আসতে থাকেন। এমনি এক সময়ে সাতক্ষীরা থেকে এ এফ এম এনতাজ আলী, পারুলিয়া থেকে আতিয়ার রহমান সাহেব শাহজাহান মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করেন। মার্চ মাসের ২৮ তারিখে গোপনে দেবহাটা হাই স্কুলে (বিবিএমপি ইনস্টিটিউশন) তৎকালীন দেবহাটা থানার ওসি হারিস উদ্দিন এর সহযোগিতায় সাতক্ষীরা ও পারুলিয়া থেকে আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের অত্র এলাকার নেতৃবৃন্দ কে নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। শাহাজাহান মাস্টার এর সভাপতিত্বে এই সভায় সর্ব সিদ্ধান্তক্রমে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এই সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হিসেবে শাহজাহান মাস্টারকে সভাপতি এবং বাবু সনৎ কুমার সেনগুপ্ত (সন্তু বাবু) কে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। পরদিন বসিরহাট টাউন হাই স্কুলের দোতালায় শাহজাহান মাস্টার, সন্তু বাবু সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এক সভা হয়। এই সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শাহজাহন মাস্টার
এবং পারুলিয়ার দেলদার আহমেদ সরদার বক্তব্য রাখেন। এ সময় যশোর ক্যান্টনমেন্টের চারপাশে তখন জোর লড়াই চলছে। পিপিআর সদস্যরা তখন বর্ডার আউটপোস্ট থেকে যশোরের দিকে চলে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় শাহজাহান মাস্টার এর নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক দেবহাটা ইপিআর ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এই অভিযানে পারুলিয়ার আতিয়ার রহমান গদাই অদম্য সাহসিকতার সাথে ক্যাম্পে ডিউটিতে থাকা পাকিস্তানি ই পি আর সদস্যকে জাপটে ধরে হাতিয়ার কেড়ে নেয় এবং অন্যান্যরা এই সুযোগে ক্যাম্পের মধ্যে প্রবেশ করে সবাইকে বন্দি করে। ক্যাম্পের মধ্যে পাঁচ জন পাকিস্তানি ই পি আর সদস্য ছিল। তাদেরকে ধরি আনার পরে নৌকায় করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। এই দিনেই দোপাট্টা থানার তৎকালীন ওসি হারেজ উদ্দিন থানা রক্ষিত হাতিয়ারগুলি হাওজান মাস্টারদের হাতে তুলে দেন। শুরু হলো এলাকার শিক্ষিত – অশিক্ষিত যুবকদের নিয়ে টাউন শ্রীপুর হাই স্কুলে মুজাহিদদের দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং দেওয়া। শুরু হল স্বাধীনতা সংগ্রাম / মুক্তিযুদ্ধের পথে পথ চলা।
তথ্য : ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের ডায়েরি থেকে নেয়া।